দিন দিন বেড়েই চলেছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের বকেয়ার পরিমাণ। বর্তমানে ওই খাতে সরকারের বকেয়া রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে গতবছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতে বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। যা এ খাতে চলতি অর্থবছরের বাজেট বরাদ্দের চেয়েও ৩০ শতাংশ বেশি। বিদ্যুৎখাতে প্রতিমাসে সরকারের বকেয়া হিসাবে সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার কোটি টাকা নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু রাজস্ব আহরণ কম হওয়ায় অর্থ মন্ত্রণালয় প্রতি মাসে মাত্র দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করতে পারছে। ফলে বকেয়ার পরিমাণ আরো বাড়ছে। জ্বালানি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর বকেয়া পরিশোধের অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বন্ড জারির পরিকল্পনা করছে সরকার। আশা করা হচ্ছে তাতে অন্তত কিছু বকেয়ার চাপ কমবে। তবে সরকারের কাছে সবচেয়ে বড় অংকের বকেয়া রয়েছে ভারতের আদানি গ্রুপের, যার পরিমাণ (৮৪০ মিলিয়ন) ৮ কোটি ডলার বা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আদানির বকেয়া পরিশোধে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। গত জুলাই থেকে এ পর্যন্ত কোম্পানিটির ২০৪ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এরমধ্যে গত মাসে ৯৭ মিলিয়ন ডলার ও চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম চার দিনে ১০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সরবরাহের অনেকগুলো উৎসের একটা হচ্ছে আদানি পাওয়ার। তবে বর্তমান সরকার ওসব সরবরাহকারীকে বিশেষ কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। অবশ্য আগামী দুই বছরের মধ্যে জ্বালানিখাতের বকেয়া বিল শূন্যে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পেট্রোবাংলা ও বিপিসি প্রতিমাসের বিলের সমপরিমাণের তুলনায় বাড়তি কিছু অর্থ পাওনাদারদের পরিশোধ করছে। কিন্তু রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎখাতের বকেয়া কমানোর একইরকম কোনো পরিকল্পনা করতে পারছে না অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুতের বকেয়া পরিশোধের জন্য গতমাসে দুই হাজার কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে, যা দিয়ে গত অর্থবছরের আগস্ট মাসের বকেয়ার কিছু অংশ পরিশোধ হয়েছে।
সূত্র জানায়, বিদ্যুৎখাতে চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ ৩৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও রাজস্ব আহরণ কমে যাওয়ার কারণে পুরোটা ছাড় করতে পারবে না অর্থ মন্ত্রণালয়। বরং পুরো অর্থবছরে ২০ থেকে ২২ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হতে পারে। বাকিটা বকেয়াই থাকবে। বিদ্যুৎখাতের বকেয়ার যে পাহাড় জমেছে যা খুবই বাজে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বকেয়া ভর্তুকি কমাতে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিয়ে অর্থ সাশ্রয় করা হতে পারে। আবার বিদ্যুৎখাতে যে যথেষ্ট অপচয়, অপব্যয় ও দুর্নীতি আছে, সেগুলো কমানো হবে।
এদিকে বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর বকেয়া পরিশোধের অংশ হিসেবে ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বন্ড ইস্যুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়, ইতোমধ্যে যার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। খুব শীঘ্রই ওই বন্ড ইস্যু করা হবে। বিদ্যুৎখাতের বকেয়া পরিশোধের জন্য গত অর্থবছর প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করে অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তুব্যাংকগুলো কম সুদের ওসব বন্ড নিতে আগ্রহী হয় না। কারণ অনেক ব্যাংকে তারল্য সংকট রয়েছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন ৫ হাজার কোটি টাকার বন্ড ছাড়া হবে। তাছাড়া, বাজেট থেকে প্রতি মাসে দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকা ছাড় করা হবে।
অন্যদিকে শেভরনের সরবরাহ করা গ্যাসের বিলসহ এলএনজি আমদানি ও জ্বালানি তেল আমদানির বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৩৭০ মিলিয়ন ডলার, টাকার অংকের যার পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জ্বালানি তেল আমদানির বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার, শেভরনের পাওনা ১২০ মিলিয়ন ডলার ও এলএনজি আমদানির বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ১১০ মিলিয়ন ডলার। এসব দেনা কমাতে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার এসে শেভরনের বকেয়া পরিশোধ বাড়িয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান জানান, বর্তমান সরকার যখন দায়িত্ব নিয়েছে, তখন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বৈদেশিক দেনা ছিল ২.৮ বিলিয়ন ডলার। সেটা কমে বর্তমানে ১.৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে প্রভাবিত না করেই বকেয়া পরিশোধ করা হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণসহ বিভিন্ন উপায়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয় করা হয়েছে। এখন বকেয়া পরিশোধে যে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে, সেটা রিজার্ভ থেকে নয়। বৈদেশিক মুদ্রার উৎস রপ্তানি, রেমিটেন্স রাতারাতি বাড়িয়ে ফেলা যাবে না। এ সব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও পাওনাদারদের টাকা দেয়া হচ্ছে।