চিরগৌরবে সমুজ্জ্বল মহান বিজয় দিবস আজ

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১২:০১ এএম
চিরগৌরবে সমুজ্জ্বল মহান বিজয় দিবস আজ

‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল...’। এই ডিসেম্বরের কুয়াশা মোড়ানো এক ভোরে বাংলার আকাশে উদিত হয়েছিল স্বাধীনতার নতুন সূর্য, উড্ডীন হয়েছিল লাল-সবুজ পতাকা। বাতাসে অনুরণন তুলেছিল অগণিত কণ্ঠের সুর ‘আমার সোনার বাংলা/ আমি তোমায় ভালোবাসি...।’এ দিনটি তাই একদিকে যেমন এ দেশের মানুষের কাছে চিরগৌরব ও আনন্দের, তেমনি একই সঙ্গে স্বজন হারানোর বুকভাঙা আর্তনাদের আর বেদনার।

মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি অর্জন করেছিল কাঙ্ক্ষিত বিজয়। ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান, দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রম আর অগণিত মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। সেই ঐতিহাসিক দিনের স্মরণে প্রতি বছরই বিজয় দিবস পালিত হয় জাতীয় গৌরবের প্রতীক হিসেবে। এবার বিজয়ের এই দিনটি আসছে এমন এক সময়ে, যখন সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন ও গণআন্দোলনের অভিজ্ঞতা নতুন করে জাতীয় ঐক্যের গুরুত্ব সামনে এনেছে।

বিজয় দিবস উপলক্ষে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। জাতীয় স্মৃতিসৌধের ইনচার্জ ও সাভার গণপূর্ত বিভাগের উপ সহকারী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন খান আনু জানিয়েছেন, স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে, রঙ করা হয়েছে মূল স্থাপনা, বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা এবং লাল সবুজের ফুল ও গাছ দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো এলাকা। ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, “যাদের আত্মত্যাগে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি, তাদের স্মরণে জাতীয় স্মৃতিসৌধে চার স্তরের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”

রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধা নিবেদন ও বিভিন্ন কর্মসূচিকে ঘিরে রাজধানীতে যান চলাচলেও দেওয়া হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা। পুলিশ সদর দপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ১৬ ডিসেম্বর রাত ৩টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকা আশুলিয়া ও ঢাকা আরিচা মহাসড়কের গাবতলী ও বাইপাইল পয়েন্টে ডাইভারশন কার্যকর থাকবে। এ সময় বিকল্প রাস্তা ব্যবহারের জন্য যানবাহন চালকদের অনুরোধ করা হয়েছে। ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, সকাল ৯টা থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

এদিকে বিজয় দিবসে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ উপলক্ষে ঢাকার কেন্দ্রীয় এলাকাতেও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ থাকবে। ঢাকা মহানগর পুলিশ এক গণবিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) দুপুর ২টা থেকে রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গভবনের আশপাশের কয়েকটি সড়কে যান চলাচল সীমিত থাকবে। আহাদ বক্স থেকে ইত্তেফাক মোড়, মতিঝিল অ্যালিকো গ্যাপ থেকে দিলকুশা ও রাজউক ক্রসিং, জিরো পয়েন্ট থেকে রাজউক অভিমুখী রাস্তায় বিশেষ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। যানজট এড়াতে বিকল্প সড়ক ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছে ডিএমপি।

বিজয় দিবস ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনেও এসেছে নানা বার্তা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে বলেন, “১৬ ডিসেম্বর জাতির অহংকার, আনন্দ আর বেদনার এক মহাকাব্যিক দিন।” তিনি শহীদদের আত্মত্যাগ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন, শোষণমুক্ত ও সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়ই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের মূল চেতনা। বিজয় দিবসে বিভাজন ভুলে একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশের অঙ্গীকারের আহ্বান জানান তিনি।

জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। তাঁর ভাষায়, “দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও অসংখ্য শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি।” তিনি বিজয়ের দিনে দল মতের ঊর্ধ্বে উঠে শান্তিপূর্ণ ও কল্যাণকর রাষ্ট্র গঠনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।

অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম মনে করেন, ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের দীর্ঘ গণতান্ত্রিক লড়াইয়েরই ধারাবাহিকতা। তিনি বলেন, “১৯৪৭, ১৯৭১ ও ২০২৪ সবই একই সুতোয় গাঁথা। সব সংগ্রামের লক্ষ্য ছিল মানুষের স্বাধীনতা, মর্যাদা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।” বিজয় দিবসে তিনি শহীদদের রক্তের কোনো বিভেদ নেই উল্লেখ করে জাতীয় ঐক্যের বার্তা দেন।

জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, বিজয় কোনো স্থির অর্জন নয়, এটি নিরন্তর সংগ্রামের নাম। তাঁর মতে, ১৯৭১ এর বিজয় যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান রাষ্ট্রের ভেতরে থাকা বৈষম্য ও গণতন্ত্রহীনতার বাস্তবতা সামনে এনেছে। বিজয় দিবসের অঙ্গীকার হওয়া উচিত অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীন প্রজাতন্ত্র গড়ে তোলা।

সব মিলিয়ে ৫৪ তম বিজয় দিবস এবার শুধু অতীতের গৌরব স্মরণ নয়, বর্তমান বাস্তবতায় জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার নতুন শপথের দিন হিসেবেই সামনে এসেছে। শ্রদ্ধা, নিরাপত্তা, নিয়ন্ত্রিত চলাচল আর রাজনৈতিক অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আবারও স্মরণ করছে সেই রক্তঝরা ডিসেম্বর, যখন স্বাধীনতার সূর্য উঠেছিল এই ভূখণ্ডে।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে