তামাক খাতকে অনেক সময় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব উৎস হিসেবে তুলে ধরা হয়। বাস্তবতা হলো, এই খাত থেকে যে রাজস্ব সরকার পায়, তামাক ব্যবহার ও উৎপাদনের ফলে সৃষ্ট সামগ্রিক আর্থিক ক্ষতির তুলনায় তা অর্ধেকেরও কম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, ২০২৪ সালে তামাকজনিত আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮৭ হাজার কোটি টাকা, যেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার তামাক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে রাজস্ব পেয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ তামাক থেকে অর্জিত রাজস্বের দ্বিগুণের বেশি ক্ষতি বহন করছে রাষ্ট্র ও সমাজ। এই ক্ষতির বড় অংশই স্বাস্থ্য খাতে। গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা, কর্মক্ষমতা হ্রাস ও অকালমৃত্যুর কারণে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিবেশগত ক্ষতি-বন উজাড়, মাটির উর্বরতা নষ্ট ও দূষণের কারণে যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এই ব্যয় সরাসরি বাজেটের কোনো একক খাতে দেখা না গেলেও, এর চাপ পড়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থা, পরিবার ও সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর। তামাক নিয়ন্ত্রণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তরুণদের ঝুঁকিতে পড়া। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের গবেষণায় উঠে এসেছে উদ্বেগজনক চিত্র। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠয়ের আশপাশের দোকানগুলোতে তামাকজাত পণ্যের সহজলভ্যতা, ফ্লেভারড সিগারেট ও খুচরা শলাকা বিক্রি এবং প্রকাশ্য বিজ্ঞাপন তরুণদের আকৃষ্ট করছে। আইন অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাক পণ্যের প্রচার নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ দুর্বল। তামাক কোম্পানরা যুক্তি দেয়, তারা কর্মসংস্থান ও রাজস্ব দেয়। কিন্তু গবেষণার তথ্য বলছে, তামাকের কারণে যে আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি হয়, তা রাজস্ব আয়ের যুক্তিকে ছাপিয়ে যায় বহুগুণে। তামাকজনিত অসুস্থতায় কর্মক্ষম মানুষের কাজ হারানো, পরিবারের আয় কমে যাওয়া এবং চিকিৎসা ব্যয়ের বোঝা দারিদ্র্য ঝুঁকিও বাড়ায়। এই প্রেক্ষাপটে তামাক নিয়ন্ত্রণকে কেবল স্বাস্থ্যগত বিষয় হিসেবে না দেখে অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন নীতির অংশ হিসেবে দেখা জরুরি। ফ্লেভারড সিগারেট ও খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ করা, বিক্রয়কেন্দ্রে বিজ্ঞাপন কঠোরভাবে বন্ধ করা এবং আইনের কার্যকর প্রয়োগ এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি তামাক কর কাঠামো এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করতে হবে, যাতে ব্যবহার নিরুৎসাহিত হয় এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে। রাষ্ট্র যদি দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যবান, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ও টেকসই অর্থনীতি চায়, তবে তামাক থেকে স্বল্পমেয়াদি রাজস্ব নয়-তামাকমুক্ত ভবিষ্যতকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। এই বিনিয়োগের সুফল রাজস্বের হিসাবের বাইরেও বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত।