ব্রহ্মপুত্র সেতুর নকশা চূড়ান্ত, বাস্তবায়নে সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা

এফএনএস (মোঃ সিদ্দিকুল ইসলাম সিদ্দিক; চিলমারী, কুড়িগ্রাম) : | প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০৬:০২ পিএম
ব্রহ্মপুত্র সেতুর নকশা চূড়ান্ত, বাস্তবায়নে সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা

চার বছর আগে সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু, নকশা চূড়ান্ত-তবু বাস্তবায়নের কোনো সিদ্ধান্ত নেই। কাগজে অগ্রগতি থাকলেও মাঠে স্থবির ‘ব্রহ্মপুত্র সেতু’ প্রকল্প। এর ফলে কুড়িগ্রামের নদীবেষ্টিত রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ আজও জেলার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের বাইরে রয়ে গেছেন।

২০২১ সালের নভেম্বর মাসে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর সেতু নির্মাণের সম্ভাবনা যাচাই করতে সেতু কর্তৃপক্ষের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল চিলমারী-রৌমারী ও চিলমারী-রাজিবপুর এলাকা পরিদর্শন করে। সে সময় চারটি সম্ভাব্য স্থান চিহ্নিত করে সমীক্ষা চালানো হয়। দূরত্ব, নদীর প্রস্থ ও গতিপথ বিশ্লেষণ করে চিলমারী উপজেলার ফকিরের হাট থেকে রৌমারী উপজেলার চরশৌলমারী এলাকাকে সেতু নির্মাণের জন্য সবচেয়ে উপযোগী হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।

পরিদর্শন দলে তৎকালীন সেতু কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত সচিব ও পরিচালক ড. মো. মনিরুজ্জামান (পিএনডি), প্রকল্প পরিচালক লিয়াকত আলী এবং উপসচিব (বাজেট) আবুল হাসান উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে ২০২২ সালের ১০ মার্চ একটি কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান মাঠপর্যায়ে সম্ভাব্যতা যাচাই কার্যক্রম সম্পন্ন করে। 

সবশেষে ২০২৪ সালের এপ্রিলে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জেভি কনসালটেন্ট সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও নকশাসহ চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিলেও এখনো প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে কোনো চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। ফলে বিষয়টি কাগজপত্রের মধ্যেই আটকে রয়েছে।

সম্ভাব্যতা সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রস্তাবিত ব্রহ্মপুত্র সেতুর মোট দৈর্ঘ্য হবে ১০ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে মূল সেতুর (স্টিল ট্রাস স্প্যান) দৈর্ঘ্য ৮ দশমিক ৯ কিলোমিটার এবং অ্যাপ্রোচ স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৮৮ কিলোমিটার। সেতুকে কেন্দ্র করে উভয় পাশে মোট ১৪ দশমিক ৪ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রকল্পটির সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা। নির্মাণকাল ধরা হয়েছে আনুমানিক ৫৪ মাস, যার মধ্যে ১২ মাস পরীক্ষা ও কমিশনিংয়ের জন্য নির্ধারিত। পরামর্শক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, প্রকল্পটি ২০২৫ সালের জুলাই থেকে শুরু করা গেলে ২০২৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্মাণ শেষ হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ব্রহ্মপুত্র নদে সেতুটি নির্মিত হলে রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলার প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ সরাসরি জেলা শহরের সঙ্গে যুক্ত হবেন। বর্তমানে সেতু না থাকায় এই এলাকার মানুষকে প্রতিদিন ঝুঁকিপূর্ণ নৌযান ব্যবহার করে নদী পারাপার হতে হচ্ছে, যা সময়সাপেক্ষ ও বিপজ্জনক।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর সেতু নির্মিত হলে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এতে বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর যানবাহনের চাপ প্রায় ৪০ শতাংশ কমবে। পাশাপাশি সেতুতে রেল যোগাযোগ যুক্ত হলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে। ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের বহুমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থাও গড়ে উঠবে।

এদিকে সেতু নির্মাণে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি না হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে। দীর্ঘদিনের ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতে তারা ব্রহ্মপুত্র সেতু নির্মাণের দাবিতে ধারাবাহিকভাবে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন।

ব্রহ্মপুত্র সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের প্রধান সংগঠক মাজু ইব্রাহিম বলেন,‘ সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে নকশা প্রস্তুত হলেও এখন পর্যন্ত কোনো বাস্তব অগ্রগতি নেই। সেতুর অভাবে রৌমারী ও রাজিবপুরের মানুষ প্রতিদিন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে আমরা গণস্বাক্ষর কর্মসূচির মাধ্যমে দ্রুত ব্রহ্মপুত্র সেতু নির্মাণের দাবি জানাচ্ছি।’

রেল, নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় সাবেক সভাপতি নাহিদ হাসান সমকাল’কে বলেন, ‘সেতু নির্মিত হলে এটি জাতীয় পর্যায় ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ভারতের আসাম, মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিজোরাম ছাড়াও নেপাল ও ভুটান ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। এতে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলবে।’

এ বিষয়ে সেতু বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক (প্রশাসন) ও উপসচিব মো. হাবিবুর রহমান সমকাল’কে বলেন, ‘ব্রহ্মপুত্র সেতু আমাদের মাস্টার প্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এবং এর ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন হয়েছে। পরবর্তীতে সরকারের নির্দেশনা পেলে সেতু নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করা হবে।’

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে