আমরা তোমাদের ভুলবো না...

মোমিন মেহেদী : | প্রকাশ: ৭ জানুয়ারী, ২০২৫, ০৭:০০ পিএম : | আপডেট: ১৯ জানুয়ারী, ২০২৫, ০৭:৩৭ পিএম
আমরা তোমাদের ভুলবো না...

সংবাদযোদ্ধা শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন, সেলিনা পারভিন ও শহীদুল্লা কায়সার ১৯৭১ সালে নিহত সাংবাদিকেরা যেমন জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন দেশ সবার আগে; তেমন নিজেদের জীবনের কথা না ভেবে সত্য তুলে ধরার চেষ্টা থেকে ২০২৪ জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহকালে গুলিতে পাঁচ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। পুলিশের গুলিতে ১৮ জুলাই হাসান মেহেদী নামের এক সাংবাদিক নিহত হন। তিনি ঢাকা টাইমস নামের একটি নিউজ পোর্টালে কর্মরত ছিলেন। ঢাকার যাত্রাবাড়িতে খবর সংগ্রহের সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। একই দিনে ভোরের আওয়াজ নামের একটি দৈনিক সংবাদপত্রের প্রতিবেদক শাকিল হোসাইন নিহত হন। ওই দিন দৈনিক নয়াদিগন্তের সিলেটে প্রতিনিধি আবু তাহের মুহাম্মদ তুরাব নামের আরেক সাংবাদিক পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। ২ আগস্ট তাহির জামান প্রিয় নামের আরেক ফ্রিল্যান্স ভিডিও সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হন। এর দুই দিন পর ৫ আগস্ট সিরাজগঞ্জে দৈনিক খবরপত্রের সাংবাদিক প্রদীপ কুমার ভৌমিক প্রাণ হারান। নিহত সাংবাদিকের সকলেই পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। দেশের জন্য নিবেদিত থাকা এই প্রাণগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা যেমন জানাই, তেমন চাই সাংবাদিকদের রুটি-রুজি-জীবন-জীবিকার পথে থাকুক বাংলাদেশের আগামী। এশিয়া মহাদেশে সাংবাদিকদের রুটি-জীবন-জীবিকা ক্রমশ স্বাধীনতা হারাচ্ছে, হারাচ্ছে নিরাপত্তাও। এশিয়ার একটি দেশ বাংলাদেশ, সেই দেশে সাংবাদিকরা রাজনীতিকদের দ্¦ারা সবচেয়ে বেশি হামলা-মামলা ও হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে। এরপর হামলা-মামলা ও টুটি চেপে ধরার দৌড়ে এগিয়ে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও প্রশাসন সমাজ। প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে হুমকি-ধমকির মুখোমুখি হতে হচ্ছে কোনো না কোনো সাংবাদিকদেরকে। পাকিস্তান-ভারত-মিয়ানমার-চীন-জাপানসহ অধিকাংশ দেশে সাংবাদিকগণ যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, হামলা-মামলার শিকার হচ্ছে, ঠিক সেভাবে বাংলাদেশে সাংবাদিকরা হামলা-মামলার শিকার হচ্ছে, কখনো কখনো সেই মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই তো গত শুক্রবার ছত্তিসগড়ের বিজাপুর জেলার একটি বাড়ির সেপটিক ট্যাংক থেকে মুকেশের লাশ উদ্ধার হয়। তার মৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড় গোটা ছত্তিসগড়ে। এরই মধ্যে চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সেই অভিযুক্তদের মধ্যে মুকেশের এক তুতো ভাইও আছেন। ‘সাহসী’ সাংবাদিকতার জন্য অনেকের নজর কেড়েছিলেন ভারতের ছত্তিসগড়ের ফ্রি ল্যান্সার সাংবাদিক মুকেশ চন্দ্রকর। আবার অনেকের চক্ষুশূলও হয়ে উঠেছিলেন। আর সে কারণেই হয়তো ‘নৃশংসভাবে’ হত্যার শিকার হতে হয়েছে তাকে। সম্প্রতি ১২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে ‘দুর্নীতি’র খবর ফাঁস করেছিলেন মুকেশ। একথা সত্য যে, প্রকৃত সাংবাদিক কাউকে ভয় করে না। মুকেশেরও ভয়ডর ছিল না। বেশ কয়েক বার তার ওপর হামলাও হয়। কিন্তু তার পরেও সত্য উদ্ঘাটনের খোঁজে ছুটে গেছেন বার বার। বিজাপুর, বস্তার জেলার অনেক দুর্নীতি ও অপরাধের পর্দা ফাঁস করেছেন। আর এই নির্ভীক সাংবাদিকতার জন্য বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছিলেন মুকেশ। সাংবাদিকতায় আসার পর মুকেশ বলেছিলেন, বস্তারের এমন অনেক ঘটনা রয়েছে, যেগুলো সংবাদমাধ্যমগুলোতে কাটছাঁট করে দেখানো হয়। তাই এলাকার বিভিন্ন পরিস্থিতির ‘আনকাট’ ছবি তুলে ধরতে নিজের একটি ইউটিউব চ্যানেলও খোলেন মুকেশ। নাম দেন ‘বস্তার জংশন’। আমি একজন সচেতন প্রযুক্তি ও গণমাধ্যম সচেতন নাগরিক হিসেবে দেখে অবাক হয়েছি যে, দেড় লাখ সাবস্ক্রাইবার ছিল সেই চ্যানেলের। মুকেশে ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা যখন হু হু করে বাড়ছিল, সেসময় তিনি তার দাদা যুকেশ চন্দ্রকরকে বলেছিলেন, মা যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে এই দিন দেখে খুব খুশি হতো। অনেক কষ্টের মধ্যে পড়াশোনা করে আজ এই জায়গায় পৌঁছেছি। মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না মুকেশদের। ২০০৫ সালে বিজাপুরে বাসাগুড়া গ্রামে চলে আসেন তারা। সেখানে তখন দশম শ্রেণি পাশ করাই অনেক বড় বিষয় ছিল। অল্প বয়সেই মাকে হারান মুকেশ। মায়ের মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেন দুই ভাই। সংসার টানতে গ্যারেজেও কাজ করতে হয়েছে তাকে। খবু কাছ থেকে এলাকার সমস্যাগুলো দেখার পর, ঘটনাগুলো প্রকাশ্যে আনতে সাংবাদিকতার পথ বেছে নেন। কোনো নতুন খবর করলেই মুকেশ এলাকার লোকজনদের ডেকে জিজ্ঞেস করতেন, ঠিক হয়েছে কি না। বিজাপুর ও বস্তার চিনতেন হাতের তালুর মতো। বছর দুই-তিনেক আগে রাওঘাট প্রকল্প নিয়ে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের হামলার শিকার হন মুকেশ। সর্বশেষ বস্তার জেলার মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে খবর করেছিলেন মুকেশ। গঙ্গালুর থেকে হিরোলি পর্যন্ত একটি রাস্তা নির্মাণের জন্য টেন্ডার হয়েছিল ৫০ কোটি টাকার। কিন্তু পরে সেই নির্মাণ খরচ ১২০ কোটি টাকায় পৌঁছে যায়। রাস্তা নির্মাণের ঠিকাদার সুরেশ চন্দ্রকরের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল রাজ্য সরকার। ঘটনার দিন চন্দ্রকর তার ভাই রীতেশ ও মহেন্দ্র রামটেকের সঙ্গে সুরেশ চন্দ্রকরের বাড়িতে নৈশভোজ করেছিলেন। সেই সময়ে তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হয়। রীতেশ ও মহেন্দ্র লোহার রড দিয়ে আক্রমণ করে মুকেশকে। হত্যার পরে সাংবাদিকের লাশ একটি সেপটিক ট্যাংকে লুকিয়ে রেখে সিমেন্ট দিয়ে ট্যাংকের মুখ জমিয়ে দেওয়া হয়। মুকেশের এই হত্যাকাণ্ডে দেশে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে ভারতের সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন। কিন্তু বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যার পরও বিচার হয় না যুগের পর যুগ। বাংলাদেশে সাংবাদিক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান ১৯৯৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ইন্তেকাল করেন, সাইফুল আলম মুকুল ৩০ আগস্ট ১৯৯৮; মির ইলিয়াস হোসাইন জানুয়ারি ১৫, ২০০০; শামসুর রহমান জুলাই ১৬, ২০০০; নাহার আলি এপ্রিল ২১, ২০০১; হারুনুর রশিদ মার্চ ২, ২০০২; শুকুর হোসাইন জুলাই ৫, ২০০২; সৈয়দ ফারুক আহমেদ আগস্ট ৩, ২০০২; মানিক চন্দ্র সাহা জানুয়ারি ১৫, ২০০৪; হুমায়ুন কবির জুন ২৭, ২০০৪ ; কামাল হোসেন আগস্ট ২২, ২০০৪; দীপঙ্কর চক্রবর্তী অক্টোবর ২, ২০০৪; শহীদ আনোয়ার অক্টোবর ২৪, ২০০৪; শেখ বেলালউদ্দিন আহমেদ ফেব্রুয়ারি ১১, ২০০৫; গোলাম মাহফুজ মে ৩১, ২০০৫; গৌতম দাস নভেম্বর ১৭, ২০০৫; বেলাল হোসেন দফাদার সেপ্টেম্বর ১৪, ২০০৬; কামরুল হাসান চৌধুরী আলীম সেপ্টেম্বর ৭, ২০০৬; ফরহাদ খা জানুয়ারি ২৮, ২০১১; গোলাম মোস্তফা সরোয়ার ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১২; মেহেরুন রুনি ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১২; অনন্ত বিজয় দাশ মে ১২, ২০১২; জামাল উদ্দিন জুন ৫, ২০১২; জুনায়েদ আহমেদ জুলাই ১০, ২০১২; তালহাদ আহমেদ কবিদ অক্টোবর ২৩, ২০১২; দেলোয়ার হোসেন মার্চ ২৮, ২০১৪; অভিজিৎ রায় ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৫; ওয়াশিকুর রহমান বাবু মার্চ ৩০, ২০১৫; মশিউর রহমান উৎস ডিসেম্বর ২৪, ২০১৫; আবদুল হাকিম শিমুল ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০১৭; সুবর্ণা নদী ২৮ আগস্ট ২০১৮; ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন ২১ মে, ২০১৯; বুরহান উদ্দিন মুজাক্কিও ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ এবং শাহজাদা মিয়া আজাদ ৩১ জুলাই ২০১৯। এছাড়াও গত ৫৩ বছরের প্রায় ৩ হাজার সাংবাদিক মিথ্যে মামলার শিকার হয়েছেন, ২ হাজার সাংবাদিক দায়িত্ব পালনকালে হামলার শিকার হয়েছেন। সাংবাদিক হত্যার বিচার যেমন আজও হয়নি, তেমনি সাংবাদিকদের উপর হামলাকারীদের বিচার হয়নি; এই চিত্র ভারতেও দেখা যায়। আর তাই চাই বাংলাদেশ সকল দেশের চেয়ে ভিন্ন পথে হাটুক। দেশে সাংবাদিকদেরকে রক্ষার জন্য ‘সাংবাদিক সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এগিয়ে আসুক চলমান সরকার। কারণ হিসেবে বলতে পারি নিঃসন্দেহে এই সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে সাংবাদিক সমাজ। যারা জীবন দিতে দিতে তুলে ধরেছে ছাত্র-যুব-জনতা বিরোধী-ফ্যাসিবাদী ভয়ংকর চিত্র। যা দেখে জেগেছে দেশ, জেগেছে বিশ্ব বিবেক... 

লেখক : মোমিন মেহেদী; চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW