চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ডিজেল পরিবহন নতুন বছরেই পাইপলাইনে শুরু হবে। তাতে অপচয় ও চুরিও অনেকখানি কমে আসবে। বছরে প্রায় ২৩৬ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এরই মধ্যে পাইপলাইনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। পাইপলাইনটি চালু হলে সড়ক ও জলপথে পরিবহনের জন্য কোনো টাকা ব্যয় হবে না। শুধু পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণ, বিদ্যুৎ বিল, জমির ভাড়াসহ কিছু খাতে ব্যয় হবে ৯০ কোটি টাকা। বছরে প্রকল্পটি থেকে আয় হবে ৩২৬ কোটি টাকা। সাশ্রয় হবে ২৩৬ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নে যে টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা আগামী ১৬ বছরের মধ্যে উঠে আসবে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, জ্বালানি তেল পরিবহনে পাইপলাইন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পরিবহন খরচ কমবে এবং সরবরাহ ব্যবস্থা নির্বিঘ্ন হবে। একই সঙ্গে পরিবেশদূষণ কমবে। শুষ্ক মৌসুমে নৌপথে নাব্য কমে যাওয়ায় তেল পরিবহনে যে সংকট হতো আর থাকবে না। বর্তমানে ঢাকায় জ্বালানি তেল পরিবহনের করতে প্রথমে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে নদীপথে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ও ফতুল্লা ডিপোতে নেয়া হয়। তারপর সেখান থেকে সড়কপথে ঢাকায় তেল পরিবহন করা হয়। তেল পরিবহনে প্রতি মাসে প্রায় ১৫০টি ছোট-বড় জাহাজ ব্যবহৃত হয়। এতে বছরে দুইশ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়। সূত্র জানায়, বছরে দেশে জ্বালানি তেলের গড় চাহিদা ৬৫ লাখ মেট্রিক টন। এ জ্বালানি তেলের ৯২ শতাংশই আমদানি করা হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার ৫৯ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে ৩০ লাখ ৮০ মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল জি-টু-জি চুক্তির আওতায় এবং ২৮ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আমদানি করা হবে। এর বাইরে ১৪ লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিপিসি। পরিশোধিত জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেল, মোগ্যাস, জেট এ-১, ফার্নেস অয়েল এবং মেরিন ফুয়েল রয়েছে। পরিশোধিত তেলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয় ডিজেল। দেশের ডিজেলের চাহিদার ৪০ শতাংশ ঢাকায় ব্যবহার হয়। বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় তেল পরিবহনের ক্ষেত্রে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। রেলওয়ের ওয়াগন থাকলেও লোকোমোটিভ পাওয়া যায় না। আর সড়কপথে পণ্য পরিবহনে যানজটসহ নানা সমস্যায় দীর্ঘ সময় লাগে। জলপথেও সমস্যা হয়। দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেল ৭০ শতাংশ। আর সরবরাহ নিশ্চিত হবে পাইপলাইনটি চালু হলে। যদিও পেট্রোল ও অকটেন আগে যেভাবে সরবরাহ করা হতো, কখনো রেলওয়ে ওয়াগনে করে, কখনো নদীপথে ট্যাঙ্কারে পরিবহন করা হবে। সূত্র আরো জানায়, নদীপথে লাইটারেজে করে পরিবহন কেন্দ্র করে একটি বিশাল সিন্ডিকেট রয়েছে। তেল চুরিকেলাইটারেজ থেকে তেল খালাসের সময় অপচয় হিসেবে জায়েজ করা হয়। পাইপলাইন হয়ে গেলে তা নিয়ন্ত্রণে আসবে। প্রকল্পটি ঠেকিয়ে রাখতে শুরুতে তেল পরিবহনকারী লাইটারেজ মালিকরা প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছিল। প্রকল্পের ব্যয় শুরুতে ধরা হয় ২ হাজার ৮৬১ কোটি ৩১ লাখ টাকা। পরে সংশোধিত হয়ে বেড়ে ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। বিপিসি অর্থায়নে গৃহীত ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য ২৩৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত ৫৯ কিলোমিটার। আর ফতুল্লা থেকে গোদনাইল ডিপো পর্যন্ত সাড়ে ৮ কিলোমিটার। এদিকে উত্তরাঞ্চলের জ্বালানি পরিবহন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন। দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় নিরবচ্ছিন্ন, দ্রুত ও সাশ্রয়ীভাবে জ্বালানি সরবরাহের জন্য ২০১৮ সালে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ৩ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৩১ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের সময়কাল ছিল ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। তবে নির্ধারিত সময়ের আগেই পাইপলাইনটি চালু হয়েছে। ভারতের নুমালীগড় থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর ডিপো পর্যন্ত বিস্তৃত ওই পাইপলাইনের মাধ্যমে বর্তমানে চাহিদা অনুযায়ী তেল আমদানি করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান জানান, চট্টগ্রাম-ঢাকা তেলের পাইপলাইন আগামী ফেব্রুয়ারিতে পরীক্ষামূলক আর মার্চে বাণিজ্যিকভাবে অপারেশনে যাবে। এ লাইন দিয়ে মূলত ডিজেল পরিবহন করা হবে। পাইপলাইনটি চালু হলে অপচয় ও চুরি অনেকখানি কমে যাবে।