নারীর প্রতি সকল ধরনের বৈষম্য দূরীকরণে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কমিশনটি একটি সুপারিশমালা প্রণয়ন করছে, যা নারীর অধিকার সংরক্ষণ এবং সমাজে লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। চলতি মাসের শেষে এই সুপারিশমালা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া হবে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, কমিশনের সুপারিশে মূলত বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) আইন সংস্কার, পুরোনো আইনগুলোর সংশোধন এবং নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সাংবিধানিক ধারা সংস্কারের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অনেক আইন ব্রিটিশ আমলের তৈরি, যা সময়োপযোগী করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ ছাড়া, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের পারিবারিক আইন সংস্কারের বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কমিশনের সুপারিশ তিনটি ভাগে বিভক্ত: এক. অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ; দুই. পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য সুপারিশ; তিন. সামগ্রিক নারী আন্দোলনের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য। বিশেষ করে, নারীর উত্তরাধিকার, সন্তানের অভিভাবকত্ব, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদে সমান অধিকার নিশ্চিতের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া, কমিশন সম্পত্তির উত্তরাধিকার, মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাসে উন্নীতকরণ, আদালতের সেবাকে আরও কার্যকর করা এবং নারীর প্রতি বিদ্যমান বৈষম্য চিহ্নিত করে তা দূর করার সুপারিশ করেছে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক বলেছেন, এই কমিশনের লক্ষ্য হলো সকল ধরনের আইনগত, নীতিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য চিহ্নিত করে সুপারিশমালা তৈরি করা। সংস্কার কমিশনের আরেক সদস্য অ্যাডভোকেট ফৌজিয়া করিম ফিরোজ মনে করেন, বিদ্যমান কিছু আইন বৈষম্যমূলক এবং তা সময়োপযোগী করা প্রয়োজন। ব্রিটিশ আমলের কিছু আইন এখনও প্রচলিত, যা আধুনিক সমাজের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। বিশেষত, খ্রিষ্টান ও হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কারের দিকে তেমন নজর দেওয়া হয়নি। সেই সঙ্গে আদালতের কার্যক্রমকে আরও ফলপ্রসূ এবং জনবান্ধব করার সুপারিশ করা হয়েছে। গত বছরের ২০ আগস্ট নারী সংগঠনগুলো প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নারীর অধিকার রক্ষায় সুপারিশ প্রদান করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮ নভেম্বর ১০ সদস্যের নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশনের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন নারী অধিকার সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, আইনজীবী, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের এই উদ্যোগ নারীর প্রতি বিদ্যমান বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে একটি ন্যায় সঙ্গত সমাজ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এখন দেখার বিষয়, অন্তর্বর্তী সরকার এবং ভবিষ্যৎ সরকার এই সুপারিশমালার বাস্তবায়নে কতটা কার্যকর পদক্ষেপ নেয়।