পাঁচ শতাধিক স্কুলে কমিটি নিয়ে মামলা, ব্যাহত শিক্ষা

এফএনএস (বরিশাল প্রতিবেদক) : : | প্রকাশ: ৭ জানুয়ারী, ২০২৫, ০৬:২৪ পিএম
পাঁচ শতাধিক স্কুলে কমিটি নিয়ে মামলা, ব্যাহত শিক্ষা

স্থানীয় দ্বন্ধের কারণে বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের অধীনে প্রায় পাঁচ শতাধিক মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি নিয়ে চরম বিরোধ ও মামলায় সৃষ্ট শিক্ষকদের দলাদলিতে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। মামলার ব্যয় চালাতে স্কুলগুলোতে চলছে অর্থ সঙ্কট। ওইসব স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও শিক্ষার মান এখন তলানিতে এসে পৌঁছেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সূত্রমতে, বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১৮শ’ মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব স্কুল আহবায়ক ও ম্যানেজিং কমিটি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ম্যানেজিং কমিটি গঠনে গোপনীয়তা, দাতা ও প্রতিষ্টাতাদের উপেক্ষা, স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই পাঁচ শতাধিক স্কুলে চলছে অস্থির অবস্থা। বিরোধ আর মামলায় জর্জরিত এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। কোনোভাবেই এ অবস্থাকে সামাল দেওয়া যাচ্ছেনা।

বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক মো. রফিকুল ইসলাম খান হেলাল বলেছেন, স্কুল কমিটিতে কে আসবে, কে আসতে পারে না, তা নিয়েই বিরোধের শুরু হয়। এমনও দৃষ্টান্ত রয়েছে যে, স্থানীয় প্রভাবে যারা স্কুলের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ও দাতা, তাদেরকেও বাদ দেওয়া হচ্ছে। প্রায়ই স্বার্থান্বেষী মহল প্রধানশিক্ষকের সহযোগিতায় গোপনে কমিটি গঠণ করে থাকে। এতে করে শিক্ষার প্রচন্ড ক্ষতি হচ্ছে। পাশাপাশি প্রধানশিক্ষকও মামলা চালাতে গিয়ে স্কুল চালাতে পারছেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর প্রাণকেন্দ্র গির্জা মহল্লা এলাকায় পৌনে দুই একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত একে (আসমত আলী খান) স্কুল। বর্তমানে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে এর অর্থ ও সম্পদ। এ স্কুলের সামনের বাণিজ্যিক স্টল থেকে মাসিক আয় ছয়লাখ টাকা। স্কুল ম্যানেজিং কমিটি এতোদিন গঠণ হয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবে। বিগত কমিটির অর্থ লোপাটে প্রধানশিক্ষক বাঁধা হওয়ায় তাকে গত চার বছর বহিস্কার হয়ে পালিয়ে থাকতে হয়েছে। অতিসম্প্রতি তিনি আইনগতভাবে দায়িত্ব নিয়ে দেখেন শিক্ষার্থী সংখ্যা অর্ধেকে নেমেছে। এছাড়া হিসেব নেই অনেক ব্যয়ের।

এনিয়ে প্রধানশিক্ষক এইচএম জসিম উদ্দীন বলেন, স্কুলের মাসিক বড় অংকের আয় ও প্রচুর সম্পদই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত কমিটি এসব অর্থ ও সম্পদ অনৈতিকভাবে ভোগ করতে চেয়েছে। এমনকি সাবেক সভাপতি দুই কোটি টাকা আত্মসাত করেছে। এতে আমি বাঁধা প্রদান করায় আমার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে বহিস্কার করে বিগত চার বছর আমাকে স্কুলের বাহিরে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি স্কুলে সৃষ্টি করেছে দলাদলি। এ কারণে স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬৫০ থেকে সাড়ে ৪৫০ তে নেমেছে। এসএসসি পরীক্ষার্থী মাত্র ৬৫ জন।

অপরদিকে, স্কুল সভাপতির রাজনৈতিক বিরাগভাজন হওয়ায় অনৈতিকতার অভিযোগে বহিস্কার হয়েও ২০ মাস পালিয়ে থাকতে হয়েছে শের-ই বাংলা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষককে। উভয়স্থলেই ঝুলছে একাধিক মামলা। শের-ই বাংলা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক মো. হারুন-অর রশিদ বলেন, আমাদের স্কুলের সভাপতি একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর। গত সিটি নির্বাচনের সময় তার প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থী এই স্কুলে আসার পর আমি তাকে সাদরে গ্রহণ করায় সভাপতি ক্ষুব্ধ হন। তারপর নানা অভিযোগ করা হয় আমার বিরুদ্ধে, দেওয়া হয় মামলা, আমাকে করা হয় বহিস্কার। আমিও পাল্টা মামলা করেছি।

তিনি আরও বলেন, সভাপতি আমাকে শুধু গুলি করে হত্যা করা বাকি রেখেছিল। আমার বিরুদ্ধে অর্থ কেলেঙ্কারি না পেয়ে সে আমার চরিত্র হরনের অভিযোগ এনে বহিস্কার করেন। একটানা ২০ মাস পালিয়ে থেকে গত ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর গত ডিসেম্বর মাসে আদালতের নির্দেশে আমি দায়িত্ব নিয়ে স্কুলে বসেছি।

সূত্রমতে, স্কুলগুলোতে ম্যানেজিং কমিটিগুলোর এমন বিরোধ ও মামলায় প্রধানশিক্ষকসহ সাধারণ শিক্ষক ও স্টাফ বরখাস্তের ঘটনা ঘটছে প্রায় প্রতিনিয়ত। এরমধ্যে মামলা-পাল্টা মামলায় জড়িয়ে কারাবাসসহ বরখাস্তর ঘটনাও রয়েছে। শিক্ষকতা করতে এসে ক্লাস রেখে শিক্ষকদের আদালতের বারান্দায় থাকতে হচ্ছে বেশিরভাগ সময়। যে কারণে সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রম বিপর্যস্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় চরম ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা। তারা অনেকেই ওইসব স্কুল থেকে তাদের সন্তানদের অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মতে দলাদলির কারণে শিক্ষকরা ঠিকমতো পড়াশোনা করাতে পারছেন না। অন্যদিকে নিজের দল ভারি করতে কোনো পক্ষই মনিটরিং করছে না। যেকারণে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের অধীন ১৮শ’ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৫০২টি স্কুলে এমন কোন্দল ও মামলা রয়েছে। ৮৬টি স্কুলের মামলা উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। এরমধ্যে ৭৬টি রিট হয়েছে, আপিল বিভাগে আছে দুইটি, রিভিউ/রিভিশনে আছে দুইটি, কন্টেপ্ট পিটিশন একটি, দেওয়ানিতে রয়েছে চারটি ও ফৌজধারি মামলা রয়েছে একটি। শিক্ষা বোর্ডের পক্ষ থেকে বিরোধ নিম্পত্তির জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।

সার্বিক বিষয়ে বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. ইউনুস আলী বলেন, উচ্চ আদালতের ৮৬টি মামলার মধ্যে গত এক বছরে আমরা ২১টি মামলার নিস্পত্তি করিয়েছি। বাকিগুলোর দ্রুত নিম্পত্তির চেষ্টা চলছে। বিরোধ ও মামলার কারণে স্কুলগুলোতে লেখাপড়ার মান ঠিক রাখা যাচ্ছেনা। শিক্ষকদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে অসন্তোষ। এক কথায় শিক্ষার পরিবেশ হারাচ্ছে। মামলা চালাতে অর্থের ব্যয় করতে গিয়ে স্কুলের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে, অর্থ সংকটে পরছে স্কুলগুলো। তিনি আরও বলেন, আমি আমার কর্মকালীন সময় এসব বিরোধ ও মামলা নিম্পত্তিতে উদ্যোগ নেবো। প্রয়োজনে বিশেষ মনিটরিং সেল গঠণ করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW