সুন্দরবন না থাকলে দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের এই অঞ্চলে টিকে থাকা সম্ভব হতো না। নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করে সুন্দরবন। সুন্দরবনের গুরুত্ব বুঝতে পেরে এই অঞ্চলের মানুষ ভালোবাসা দিবসটিকে সুন্দরবন দিবস হিসেবে পারন করে থাকে। ইতিমধ্যে উপকুলবাসী দিবসটি পালন করতে বিভিন্ন কর্মসুচী হাতে নিয়েছে। নানা অনুষ্ঠান মালার মধ্য দিয়ে পালন করা হবে দিবসটি। ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে বিশ্বজুড়ে ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন করা হলেও সুন্দরবন উপকূলীয় জনপদের মানুষরা ‘সুন্দরবন দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে খুলনাসহ উপকূলীয় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দুই দশক ধরে দিনটি সুন্দরবন দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষায় নাগরিকজোট-সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা ফাউন্ডেশন বলছে, ২০০১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ৭০ টি পরিবেশবাদী সংগঠনের অংশগ্রহণে প্রথম জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সুন্দরবন দিবস’ ঘোষণা করা হয়। সুন্দরবন সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় (ম্যানগ্রোভ) বন। জীববৈচিত্র্যের প্রাচুর্যের জন্য ১৯৯২ সালে সুন্দরবনকে রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আর ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেসকো সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়ায় সুন্দরবন এখন দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এক ভ্রমণকেন্দ্র। বন বিভাগ সুত্রে জানা গেছে , বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে অনুপম অদ্বিতীয় সুন্দরবন গড়ে ওঠেছে অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীববৈচিত্র্য নিয়ে। বৈজ্ঞানিক, নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিবেচনায় সুন্দরবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বনের মোট আয়তনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগই হচ্ছে জলাভূমি। বিশ্বের অন্যান্য ম্যানগ্রোভ বনের তুলনায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য অধিকতর সমৃদ্ধ। এই বনে সুন্দরীসহ রয়েছে ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড। বাঘ, হরিণ, কুমির, কিং কোবারা,ইরাবতিসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন, ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও ২১০ প্রজাতির মৎস্য সম্পদ। সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা কয়রা কপোতাক্ষ কলেজের সাবেক অধ্যাপক আ, ব,ম আঃ মালেক বলেন , জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই জনপদ এখানো টিকে আছে শুধু সুন্দরবনের আশ্রয়ে। দেশের সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরের অববাহিকায় গড়ে উঠেছে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। সুন্দরবন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি-জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। এ বনের অপরূপ সৌন্দর্য ভ্রমণপিপাসুদের হাতছানি দেয়। তবে সুন্দরবন এখন অস্তিত্ব সংকটে। কিছু মানুষের লোভ-লালসা আর অপকর্মের শিকার হচ্ছে বননির্ভরশীল মানুষ ও গোটা বনের জীববৈচিত্র্য।। বন বিভাগ বলছে, একসময় এ বনে বাস করত অন্তত ৪০০ প্রজাতির পাখি। যা কমতে কমতে এখন ২৭০ প্রজাতিতে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাড়ছে সাগর-নদীর পানির উচ্চতা ও লবণাক্ততা। কমে যাচ্ছে সুন্দরবনের কম লবণসহিষ্ণু গাছপালা, কমছে বন্যপ্রাণীর বিচরণ ক্ষেত্রও। সমুদ্রে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রাকৃতিকদুর্যোগ ছাড়াও পূর্ণিমা ও আমাবস্যার জোয়ারে বনের অনেক উঁচু এলাকা তলিয়ে পানিতে নষ্ট হচ্ছে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। এতে ব্যাহত হচ্ছে বণ্যপ্রাণীর বংশবিস্তার। উজান থেকে মিঠা পানির প্রবাহ না থাকায় মিঠা পানির স্বল্পতা দেখা দিচ্ছে বনে।
সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী শুভ্র শচীন বলেন, ‘সুন্দরবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশ। সুন্দরবন মায়ের মতোই প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে আমাদের রক্ষা করে। যারা বুঝে বা না বুঝে এ বনের ক্ষতি সাধন করে আসছেন, তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকেই রুখে দাঁড়াতে হবে। কারণ, এর টিকে থাকার ওপর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের বেঁচে থাকা, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, সমৃদ্ধি অনেকাংশেই নির্ভরশীল। তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন প্রাকৃতিক রূপ বদলানো নয়নাভিরাম এ বনের মোট আয়তনের ৫২ ভাগই এখন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ। সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি রক্ষায় সুন্দরবন ওপর থেকে পর্যটকদের চাপ কমানো পাশাপাশি বনের আশপাশে শিল্প কারখানা নির্মাণ বন্ধ করা। সব এলাকায় বনজীবীদের প্রবেশ না করানো। বনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসকারী চোরাশিকারি, জলবায়ুর পরিবর্তনে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি রোধ, বনজীবিদের বিকল্প কর্মসংস্থান এবং বণ্যপ্রাণী, শিকারি, কাঠপাচারকারী ও বনে আগুন দেয়া দমন প্রয়োজন। সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের ডিএফও এজেডএম হাছানুর রহমান বলেন, সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় বন বিভাগের লোকজন দিনরাত আন্তরিকতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। সকলের সহযোগিতায় বিশ্বের ঐতিহ্য সুন্দররবনকে ভাল রাখা সম্ভব হচ্ছে । খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, সুন্দরবন প্রকৃতিগতভাবেই সৃষ্টি এবং প্রকৃতিই এর রক্ষক। তারপরও এ বন ও এর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপের পাশাপাশি অনেক প্রকল্পও বাস্তবায়ন হচ্ছে। সব মিলিয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি ভালো রয়েছে সুন্দরবন।