তিনজনকে গুলি করে হত্যা: দ্বায় স্বীকার ক্ষুদে বার্তা

এফএনএস (টিপু সুলতান,কালীগঞ্জ,ঝিনাইদহ) : | প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ০৬:৩১ পিএম
তিনজনকে গুলি করে হত্যা: দ্বায় স্বীকার ক্ষুদে বার্তা

ঝিনাইদহের শৈলকুপায় পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) সামরিক কমান্ডর হানিফ (৫৬), তার শ্যালক লিটন হোসেন (৩৬) ও  রাইসুল ইসলাম (২৮) সহ তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। শুক্রবার রাত ৯টার দিকে ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু, শৈলকুপা ও কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানার সীমান্তবর্তী উপজেলার রামচন্দ্রপুর ত্রিবেণি শ্মশান খাল এলাকায় এ হত্যার ঘটনা ঘটে। তবে ঘটনাস্থলটি শৈলকুপা উপজেলার মধ্যে পড়েছে। খবর পেয়ে রাত ১২ টার দিকে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও র‌্যাব ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের লাশ উদ্ধার করে। এদিকে রাতেই হত্যার দায় স্বীকার করে চরমপন্থী সংগঠন জাসদ গণবাহিনীর নেতা কালু পরিচয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে খুদে বার্তা পাঠায়। এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে এক সময়ের চরমপন্থী অধ্যুষিত এ এলাকার মানুষের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হত্যাকান্ডের পর পুলিশের পাশাপাশি সিআইডি ও পিবিআই এর একাধিক টিম ঘটনা তদন্তে কাজ করছে। হত্যাকান্ড নিয়ে স্থানীয়রা কেউ সংবাদকর্মীদের সাথে কথা বলতে রাজি হননি। তারা শুধু বলেন, ভাই আমরা বেঁচে থাকতে চাই।

একই স্থানে ২০০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর পাঁচজনকে হত্যা করা হয়েছিল। প্রায় দেড় দশক পর ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় আবারো অশান্ত হয়ে উঠার শঙ্কা দেখা দিয়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক সময়কার চরমপন্থী অধ্যুষিত জেলা ঝিনাইদহ। যদিও পুলিশ বলছে, দুটি পক্ষের অভ্যন্তরিন কোন ঘটনার সুরাহা না হওয়ায় এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। এনিয়ে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে দুপুর ১২টার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান জাকারিয়া। 

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, শুক্রবার ‘রাত ৯টার দিকে বেশ কিছু গুলির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। পরে পুলিশ আসলে বের হয়ে দেখতে পায়, ইবি থানার পিয়ারপুর ও শৈলকুপার রামচন্দ্রপুর গ্রামের মাঠের মধ্যে শ্মশানঘাট এলাকায় একটি বাঁশ ঝাড়ের নিচে দু’টি কালো রঙের পালসার মটরসাইকেল পড়ে আছে। যার একটি নম্বর চুয়াডাঙ্গা ল-১২-০১২৩ অপরটির কোন নম্বর নেই। মটরসাইকেলের পাশে পড়ে আছে হেলমেট। তার পাশে পড়ে আছে একটি মৃতুদেহ। ১৫/২০ হাত সামনে আরো একটি লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। তার থেকে আরো একটু এগিয়ে রাস্তার পাশের একটি ধানের জমির মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে ছিল আরো একটি মরদেহ। এ তিনজনকে গুলি করে হত্যার পর ফেলে রাখা হয়েছে। 

রামচন্দ্রপুর এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম জানান, রাতে ৮টার পরে তারা মাঠের দিকে বেশ কয়েকটি গুলির শব্দ শুনতে পান। তবে ভয়ে আর কেউ ঘর থেকে বের হননি। কিছু সময পর রাত সাড়ে ১০ টার দিকে এলাকাবাসী একত্রিত হয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনটি মরদেহ ও দুইটি মোটরসাইকেল পড়ে থাকতে দেখেন। এরপর তারা পুলিশে খবর দেন।


নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে নিহত হানিফ হরিনাকুন্ডু উপজেলার আহাদনগর গ্রামের রাহাজ উদ্দিনের ছেলে ও পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা ছিলেন। তার শ্যালক একই উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের উম্বাদ আলীর ছেলে লিটন ও কুষ্টিয়া ইবি থানার পিয়ারপুর গ্রামের রাইসুল ইসলাম। শনিবার সকালে নিহতদের আত্মীয় ও পরিবারের স্বজনরা এসে মৃতদেহ সনাক্ত করেন। তারা সবাই চরমপন্থী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে জানা গেছে। নিহত হানিফ হরিণাকুন্ডু থানা মৎসজীবি লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলেন। জোর করে দখলে নেওয়া উপজেলা রামদিয়া বাওড়ে মাছের চাষ করতেন। তার বিরুদ্ধে কমপক্ষে ১৩ হত্যাসহ বহু মামলা রয়েছে। ১৯৯৯ সালে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। হানিফ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। হরিণাকুন্ডু উপজেলার কুলবাড়িয়া গ্রামের আব্দুর রহমান হত্যা মামলায় তার ফাঁসির আদেশ হয়। হাসিনা সরকারের সময় রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমা নিয়ে ১৫ বছরের জেল জীবন শেষে এলাকায় ফিরে আসেন। এরপর মৎস্যজীবী লীগের উপজেলা কমিটির সহ-সভাপতি নিযুক্ত হন। আওয়ামী লীগের ভয় দেখিয়ে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেন। হানিফের এক ভাই হড়িনাকুন্ডু উপজেলার ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। আরেক ভাই উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ সভাপতি।


এদিকে, হত্যার বিষয়ে চরমপন্থী সংগঠন জাসদ গণবাহিনীর নেতা কালু পরিচয়ে দায় স্বীকার করে তিন গণমাধ্যমকর্মীর হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠিয়েছেন। চরমপন্থী নেতা কালুর পাঠানো বার্তায় বলা হয়েছে, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনাবাসীর উদ্দেশে জানানো যাচ্ছে, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী কুখ্যাত ডাকাত বাহিনীর শীর্ষ নেতা অসংখ্য খুন, গুম, দখলদারী, ডাকাতি, ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হরিণাকুণ্ডুনিবাসী হানিফ তার দুই সহযোগীসহ জাসদ গণবাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছেন। এই অঞ্চলের হানিফের সহযোগীদের শুধরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো, অন্যথায় আপনাদের একই পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে। তবে, স্থানীয়রা কেউ কেউ কালু কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পশ্চিম আব্দালপুর গ্রামের বাসিন্দা বললেও বর্তমানে সেখানে ওই নামে কোন বক্তি বসবাসের খবর পওয়া যায়নি। ।এদিকে হত্যাকান্ডের ঘটনাস্থল শৈলকুপার ত্রিবেণী ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর শ্মশান ঘাটের ওই স্থান থেকে রাতেই শর্টগানের ৭ রাউন্ড ও পিস্তলের ৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে পুলিশ। এর মধ্যে শুধুমাত্র শর্টগানের ৪ রাউন্ড গুলি বিষ্ফারিত ছিল।এদিকে শৈলকুপা থানায় আসা নিহতের স্বজনদের সাথে কথা বল জানা যায়, হানিফ আলীর সাথে সমপ্রতি ৫ আগস্টের পর হরিনাকুন্ডু উপজেলার রামদিয়া বাওড়ের দখল নিয়ে পাশ্ববর্তি চুয়াডাঙ্গা জেলার তিয়োড়বিল এলাকার বিএনপির কিছু মানুষের বিরোধ তৈরি হয়। প্রায়ই তারা বাওড়ের মাছ মেরে নিত বলেও অভিযাগ ছিল। তবে তাদের পরিচয় জানা যায়নি।

নিহত হানিফের ভাই উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সাজেদুল ইসলাম ইশা বলেন, গতকাল সকালে ভাই মাঠে কুষি কাজ করেছিল। বিকালে মোবাইলে একটি কল আসে। এরপর ভাই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। সন্ধা থেকে তার ফোনে কল দিলে ফোন রিসিপ হচ্ছিল না। পরে গভীর রাতে তার মৃত্যুর সংবাদ জানতে পারি।

এদিকে শৈলকূপা থানায় আসা নিহত রাইসুল ইসলামের মামা মোহাম্মদ মিল্টন বলেন, লিটন পিয়ারপুর গ্রামের নানা বাড়ি বেড়াতে এসেছিল। লেখাপড়া শেষ করে রাইসুল চাকরীর চেষ্টা করছিল। কুষ্টিয়ার এক এমপির সাথে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তবে ঠিক কি কারনে তাকে হত্যা করা হয়েছে তা জানতে পারিনি। ঘটনার আগে বিকাল ৫ টার দিকে নানা বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। সন্ধা থেকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে রাতে জানতে পেলাম রাইসুল মাডার হয়েছে। শৈলকুপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুম খান বলেন, সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌছে আমরা তিনজনের মরদেহ পেয়েছি। যাদের সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এদিকে ঘটনা জানাতে ঝিনাইদহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান জাকারিয়া তার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, শুক্রবার দিবাগত রাতে বন্দুকধারীরা দুই সহযোগিসহ পুর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক কমান্ডার হানিফকে গুলি করে হত্যা করে। খবর পেয়ে রাত সাড়ে ১২টার দিকে শৈলকুপা উপজেলার ত্রিবেনী ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর শ্মশান ঘাট এলাকার একটি খালের পাশ থেকে নিহতদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনজনের মাথায় গুলির চিহ্ন রয়েছে। নিহত হানিফ প্রায় দু’ডজন হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলার আসামী। হত্যার মোটিভ উদ্ধারে পুলিশের পাশাপাশি পিবিআই ও সিআইডি কাজ করছে। ধারনা করা হচ্ছে দুটি পক্ষের অভ্যন্তরিন কোন ঘটনার সুরাহা না হওয়া এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে। সাংবাদিকদের কাছে কালু নামে এক ব্যক্তির পরিচয়ে আসা ক্ষুদে বার্তা নিয়েও তদন্ত চলছে। মামলার গ্রহনের প্রস্তুতি চলছে বলেও যোগ করেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। চরমপন্থী হানিফ আলি সম্পর্কে আরো তথ্য..

হানিফ আলীর বাড়ি ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার আহাদনগর গ্রামে। পিতার নাম রাহাজ উদ্দিন। হানিফ আলী দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শীর্ষ চরমপন্থী সংগঠন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি জনযুদ্ধ (লাল পতাকার) আঞ্চলিক কমান্ডার। ৯০ এর দশকে হত্যা ও ডাকাতির মাধ্যমে এলাকার অপরাধজগতে একক আধিপত্ত বিস্তার করে। হানিফের নামে হরিণাকুন্ডু, ঝিনাইদহ সদর, চুয়াডাঙ্গা, আলমডাঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় ১৩ হত্যাসহ অপহরণ ও ডাকাতির দুই ডজন মামলা রয়েছে। গত ৭-৮ বছর ধরে হরিণাকুন্ডুর নারায়নকান্দি কায়েতপাড়া বাওড় দখল করে মৎস্য চাষ করে আসছিল। এরপর ১৯৯৯ সালে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। ২০১৪ সালে জেল থেকে বের হয় হানিফ। পরে ২০১৮ সালে ওই বাওড়ের মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি জিয়াউর রহমান জিয়াকে জবাই করে হত্যা করে বাওড়ের দখল নেয় হানিফ। সমপ্রতি বাওড় দখলকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের সাথে বিরোধ চলছিল। এ কারণেই তাকে হত্যা করেছে বলে ধারণা এলাকাবাসীর। একটি হত্যা মামলায় হানিফের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। ওই ব্যক্তিকে গলা কেটে হত্যা করে মাথা নিয়ে ফুটবল খেলেছিল বলেও এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে