ধর্ষণ-নির্যাতন রোধে আলোকথা

মোমিন মেহেদী
| আপডেট: ২১ এপ্রিল, ২০২৫, ০৭:১৩ পিএম | প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ০৬:৪৪ পিএম
ধর্ষণ-নির্যাতন রোধে আলোকথা

সারাদেশে শিক্ষার্থীদের দল গঠনের চেষ্টা চলছে। ছাত্র-যুব-জনতার একটি অংশ সন্ত্রাস-নৈরাজ্য-অপরাধ-দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়ছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে যখন সারাদেশে শিক্ষার্থীদের নিয়োগকৃত অন্তবর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে যখন ‘ডেভিল হান্ট’ চলছে, তখন পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে ধর্ষণের ঘটনা। ধর্ষণ ও গণধর্ষণ শেষে হত্যার শিকারও হচ্ছেন কোনো কোনো নারী ও শিশু। কোনো কোনো ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হলেও কোনো কোনো ঘটনা থাকছে তদন্তের বাইরে। আবার যে-সব ঘটনায় বিচার হচ্ছে, সেখানেও অভিযুক্তের সাজার হার খুবই নগণ্য। বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার বাংলাদেশ এক গবেষণায় বলেছে, দেশে ২০০৫ সালের জানুয়ারি থেকে থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ২৫ হাজার ৩০০ টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ হাজার ৮৮টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে; আর সাজা হয়েছে মাত্র ৩৭২ জনের! সাজার নগণ্য হারের ক্ষেত্রে ধর্ষকের সামাজিক অবস্থান, ধর্ষণের শিকার নারীর দুর্বল বায়োলজিক্যাল এভিডেন্স, সাক্ষীর অভাব, আইনি দুর্বলতাসহ বিলম্বিত বিচারই দায়ী বলে আমি মনে করি। এসব সমস্যার সমাধান করে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করে সাজা দেওয়া গেলেই ধর্ষণের ঘটনা অনেকাংশেই কমানো সম্ভব হবে বলে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বরাবরই বলে এসেছি রাজপথে-গণমাধ্যমে, লিখেছি পত্রিকায়। সর্বশেষ গত ৭ মাসে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। তবে ধর্ষণের অভিযোগে যে-সব মামলা হয় এবং অভিযুক্তের যদি দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে হয়ত এটা নিরোধক হিসেবে কাজে দিতে পারে। কারণ অভিযুক্তকে যে শাস্তিই দেওয়া হোক না কেন, সেটা যেন তাড়াতাড়ি দেওয়া হয়। দ্রুত শাস্তি হলে এর প্রভাব সমাজে পড়তে বাধ্য। শুধু দ্রুত বিচারই নয়, পাশাপাশি মানুষকে বিপথগামী করে এমন সব বিষয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। একথাও সত্য যে, খুন-গুম-ছিনতাই-ডাকাতি-দখলের ঘটনাগুলোর মত ধর্ষণের ঘটনাগুলোর বিষয়েও তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনে প্রচুর দুর্বলতা রয়েছে। তাই সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে কোনো মামলায় আসামি খালাস পেয়ে গেলেই দোষটা পড়ে বিচারকদের ওপর। এমতাবস্থায় আমি মনে করি- তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনকে যথাযথ প্রশিক্ষণ জরুরি, সেই সাথে আরো জরুরি ওয়ান স্টপ সার্ভিস শুরু করা। যাতে করে ভিকটিমকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে নেওয়া যায় এবং তদন্ত সাপেক্ষে অপরাধীদেরকে সর্বোচ্চ ৩ মাসের মধ্যে ফাঁসি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। 


আপনাদের মনে আছে কিনা জানি না, আমি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি- ২০১৭ সালে দুটি ধর্ষণের ঘটনা সারাদেশে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। এর মধ্যে একটি ছিল বনানীর রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীর ধর্ষণের ঘটনা। আরেকটি আলোচিত ঘটনা ছিল বগুড়ার শ্রমিক লীগের নেতা তুফান সরকার কর্তৃক এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ শেষে ঐ শিক্ষার্থী ও তার মাকে মাথা ন্যাড়া করে আটকে রাখার ঘটনা। দুটি ঘটনার পরই দেশব্যাপী ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি দ্রুত বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয় মানুষ। সরব হয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারে সোপর্দ করা হয় আসামিদের। কিন্তু আড়াই বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো দুটি মামলার একটিরও নিষ্পত্তি হয়নি। এভাবে বাংলাদেশে যেন আর কোনো ধর্ষণের ঘটনার বিচার নিয়ে তাল বাহানা না করা হয়, সেই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। 


অবশ্য বেসরকারি সংস্থা ‘নারী পক্ষ’ গবেষণার অংশ হিসেবে ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত দেশের ছয়টি জেলায় ৪ হাজার ৩৭২টি ধর্ষণের মামলা পর্যবেক্ষণ করেছিলো। তারা উল্লেখ করেছিলো- ঢাকায় ১ হাজার ৮২০টি, জামালপুরে ৮৭২টি, সিরাজগঞ্জে ৯২৫টি, নোয়াখালীতে ৩৭৮টি, ঝিনাইদহে ২৪০টি ও জয়পুরহাটে ১৩৭টি ধর্ষণের মামলা হয়। প্রায় সাড়ে চার হাজার মামলার মধ্যে ৯৮৯ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। খালাস পেয়েছে ২৮৯ জন। আর শাস্তি দেওয়া হয়েছে মাত্র পাঁচ জনকে! বিচারাধীন রয়েছে ৩ হাজার ৮৯টি ধর্ষণের মামলা। এমন একটা সময়ে এসে বলতেই হচ্ছে- ধর্ষণের মামলাগুলো আইন, তথ্য-উপাত্ত ও সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে প্রমাণ করতে হয়। এগুলোর একটির সঙ্গে আরেকটির যোগসূত্র রয়েছে। এই যোগসূত্রের কাজটি খুবই জটিল। যেখানে একজন ভিকটিম ব্যর্থ হচ্ছে, তার মানে এই নয় যে নির্যাতনের ঘটনাগুলো মিথ্যা। ধর্ষণের ঘটনাটিকে প্রমাণ করার জন্য যে প্রক্রিয়া নারীর জন্য রাখা হয়েছে, সেটা তার অনুকূলে নয়। নারীকেই প্রমাণ করতে হয় যে কী করে তার ওপর ঘটনাটি ঘটেছে। সেখানে অন্যান্য সংস্থা সমন্বয়কের ভূমিকা রাখছে না। সে কারণে আমরা মনে করি বিচার প্রক্রিয়া নারীর অনুকূলে আসছে না। যেমন ধর্ষণের শিকার নারীর ডাক্তারি পরীক্ষা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডাক্তারি পরীক্ষায় দুর্বলতার কারণে প্রমাণ হারিয়ে যায়। এই সকল সমস্যা সমাধানে সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরকে কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে, সুপরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তা না হলে এখন যেমন ধর্ষণের শিকার কোনো নারী আদালতে বিচারের সময় অভিযুক্তের কৌঁসুলি দ্বারা তার চরিত্র নিয়ে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হন। ভিকটিমকে মানসিকভাবে হেনস্তা করতেই এমন কৌশল নেন আসামির আইনজীবীরা। এভাবেই ধর্ষককে সাপোর্ট দেয়ার জন্য তথাকথিত আইনজীবীরা এগিয়ে যাবে বরাবরের মত। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই চাই- সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারা সেই সুযোগ করে দিয়েছে, সেই ধারা বাতিল করে ধর্ষকের শাস্তি ৩ মাসের মধ্যে কার্যকরের দাবি জানিয়ে আসছে ছাত্র-যুব-জনতার রাজনৈতিক মেলবন্ধন নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি। এই রাজনৈতিক প্লাটফর্মটি গত ১২ বছর ধরে রাজপথে আছে ছাত্র-যুব-জনতার দাবি বাস্তবায়নের জন্য। ২০১২ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে আত্মপ্রকাশের পর সেই দিন নতুনধারার নেতৃবৃন্দ ধর্ষণরোধে ৩ দফা দাবিও উপস্থাপন করেছিলেন। এরপর ২০১৫ সালে এক সেমিনারে ১৫৫ (৪) ধারা বাতিলের আহ্বান জানিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছিলেন, প্রকাশ্য আদালতে যৌন হয়রানির শিকার কোনো নারীর চরিত্র নিয়ে জেরা করা ঠিক নয়। কিন্তু ধর্ষণের শিকার নারীকে সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা বলে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেন আসামিপক্ষের কৌঁসুলিরা। এই জেরার উদ্দেশ্য ভিকটিমকে দুশ্চরিত্রা প্রমাণ করা। ঐ বিধানটি কালো, ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণার। এছাড়া দণ্ডবিধিতে ধর্ষণের সংজ্ঞা নিয়েও আপত্তি রয়েছে প্রকৃত মানবাধিকার সংগঠনগুলোর। ফ্যাসিস্টেও আখ্যা নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার সেই দাবি না মানায় আজ জাতি খেসারত দিচ্ছে। শুধু এখানেই শেষ নয়, শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর গত সাত মাসে দেশে ধর্ষণ ও গণপিটুনির ঘটনা বেড়েছে। সেপ্টেম্বরে গণপিটুনির সংখ্যা ছিল ২০টি। আর অক্টোবরে গণপিটুনির ঘটনা ঘটে ২৬টি। নভেম্বরে ১১৮ টি, ডিসেম্বরে ৭৮ টি, জানুয়ারিতে এসে সেই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৯৬ টি। গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে শিশু ধর্ষণ বৃদ্ধি পায় ৯২ দশমিক ৬৮ শতাংশ এবং নারী ধর্ষণ বৃদ্ধি পায় ৪৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ বলে জানিয়েছে স্বয়ং প্রথম সারির গণমাধ্যমগুলো। 


অক্টোবরে ধর্ষণের শিকার হন ২৮ জন নারী ও ২৪ জন শিশু। সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে শিশু ধর্ষণ বৃদ্ধি পায় ৯১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। নারী ধর্ষণ বৃদ্ধি পায় ৪৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এ ছাড়া, পূর্ব শত্রুতা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানি করতে মামলা দায়ের, দুষ্কৃতিকারীদের দ্বারা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকের রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি ঘটনা নিয়ে নিয়ে সরব ছিল গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। শুধু ফেব্রুয়ারি মাস নয়, বছরের প্রতিটি মাস, সপ্তাহ, দিনে দেশের কোনো না কোনো স্থানে ঘটেছে নারী নির্যাতনের ঘটনা। এসব ঘটনার একটার রেশ কাটতে না কাটতেই সামনে এসেছে অন্য ঘটনা। বছরজুড়ে এসব ঘটনার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা তো ছিল। এর পাশাপাশি দলবদ্ধ ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, উত্ত্যক্তকরণ, নারী ও কন্যাশিশু পাচার, এসিডদগ্ধ, যৌতুক, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতন, আত্মহত্যা, ফতোয়া, বাল্যবিবাহ, সাইবার ক্রাইমের ঘটনাসহ রয়েছে আরও অগণিত ঘটনা। বিশেষ করে যদি বলি, তাহলে বলতে হয় যে, জাতি হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয় মুসলিম দেশের নাগরিকদের মধ্যে একটি দুশ্চরিত্র গোষ্ঠী ২০২৪ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার করেছে মোট ৭২২ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ‑পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৫২ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে ২৬ জন। ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছে ৩২৫ জন। এর মধ্যে ধর্ষণের চেষ্টার পর হত্যা করা হয় ১২ জনকে। এ ছাড়া ২০২৪ সালে ২১৩ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মারা যায় ৩ জন। আর রহস্যজনক মৃত্যু হয় ১২ জনের। আরো মানবেতর বিষয় হলো- ২০২৪ সালে ১ হাজার ৭৭২ টি নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে তৈরি হতে হবে সবার আগে আইনের সংস্কৃতি বাস্তবায়নের জন্য। সেই সাথে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপও থাকতে হবে বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের শান্তি-নিরাপত্তার লক্ষ্যে...

লেখক : মোমিন মেহেদী; ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক পূর্বাভাস