অনিয়ম-দুর্নীতিতে জর্জরিত রামু খিজারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়

এফএনএস (সোয়েব সাঈদ; রামু, কক্সবাজার) : : | প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ০৬:৫০ পিএম
অনিয়ম-দুর্নীতিতে জর্জরিত রামু খিজারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়

সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি এবং নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে কক্সবাজার জেলার প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রামু খিজারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। ৫ বছর ধরে নেই বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব। ২০১৮ সালের পর থেকে হয়নি ক্রীড়া, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রশংসাপত্র বাবদ ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা, নবম শ্রেণির অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের জনপ্রতি ২ হাজার টাকা করে নিয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ার সুযোগ দেয়া, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের পূরণকৃত ফরম চেক লিষ্টের নামে ২০০ টাকা করে আদায়সহ নানাভাবে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নুর আহমদের বিরুদ্ধে।

ইতিপূর্বে রামুর সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাহমিদা মুস্তফার এক তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নুর আহমদ জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে এ বিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন এবং তথ্য গোপন করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর হতে আয়ন-ব্যয়ন ও আর্থিক ক্ষমতা সহ প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) এর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নুর আহমদের লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান শোচনীয় পর্যায়ে এসেছে। পাঠদান হচ্ছে দায়সারাভাবে। প্রধান শিক্ষককের অনিয়মের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে বেতন আটকে রেখে এবং নানাভাবে সহকারি শিক্ষকদের হয়রানি করা হচ্ছে। বিদ্যালয়ে জাতীয় দিবসগুলোও পালন করা হয় না।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক এবং দাপ্তরিক কার্যক্রমেও চলছে হযবরল অবস্থা। অষ্টম, নবম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশনে অসংখ্য শিক্ষার্থীদের তথ্য ভুল লিপিবদ্ধ হয়েছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বারবার প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়ে এসব ভুল সংশোধনের জন্য বারবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনে একজনের ফরমে আরেকজনের ছবি দেয়া হয়েছে। আবার নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত বৌদ্ব ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের মধ্যে শ্রেয়া বডুয়াসহ সবার অষ্টম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশনে বৌদ্ধ ধর্মের পরিবর্তে লিপিবদ্ধ হয়েছে খৃষ্টান ধর্ম। এভাবে বিদ্যালয়ের দায়সারা দাপ্তরিক কর্মকান্ডে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ভোগান্তি চরম আকার ধারন করেছে। এসব কারণে অনেক অভিভাবক সন্তানদের এ বিদ্যালয় থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

এদিকে রামু বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি জসীম উদ্দিন, রাব্বি আমিন ও মো. পারভেজ জানিয়েছেন- ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নুর আহমদ তথ্য গোপন করে প্রধান শিক্ষকের পদ দখল, সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বর্তমানে বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। ১১১ বছরের প্রাচীন এ বিদ্যাপীঠকে রক্ষায় তারা গত ২৬ জানুয়ারি অনিয়ম-দুর্নীতির হোতা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নুর আহমদের বিরুদ্ধে তথ্য গোপন, অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের দাবিতে রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. রাশেদুল ইসলামের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে- সরকারি বিধি মোতাবেক একটা সরকারি বিদ্যালয়ের নিয়মিত প্রধান শিক্ষক ও সহকারি প্রধান শিক্ষক না থাকায় জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে যিনি সিনিয়র সেই প্রধান শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু ক্রমিক এক নুরুল হোছাইন ০১/০৮/১৯৯৬ সালে অত্র বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ক্রমিক দুই বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নুর আহমদ যোগদান করেন ০১/১১/১৯৯৪ সালে। এরপরও তিনি জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে অত্র বিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন এবং তথ্য গোপন করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর হতে আয়ন-ব্যয়ন ও আর্থিক ক্ষমতা সহ প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) এর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকে অর্থাৎ ২০১৮ সালের পর থেকে কোন ধরনের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়নি। ফলে ক্রীড়া, সাহিত্য, সংস্কৃতির ধারক ও বাহক জেলার সর্বপ্রাচীন এই বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ক্রীড়া ও সৃজনশীল চর্চা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক একজন দুনীর্তিবাজ। তিনি বিনা রশিদে এসএসসি ও অন্যান্য প্রশংসা পত্র বাবদ- ৫০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা আদায় করছে। যা সম্পূর্ণ বিধি বহির্ভুত। নবম থেকে দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করে দেয়ার জন্য প্রতি ছাত্র থেকে ২ হাজার টাকা করে উৎকোচ নিয়েছেন। যার ভিডিওচিত্র রয়েছে। চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ফরমপুরনের পর পরীক্ষার্থীদের চেক লিস্ট চেক করা ও স্বাক্ষর করার নামে ৭০ টাকা করে আদায় করেছেন।

বর্তমানে বিদ্যালয়ের আর্থিক আয়ন-ব্যয়নের কোন স্বচ্ছতা নাই। বিগত ২০১৯ সালের পর থেকে বিদ্যালয়ের ক্যাশ বই, জমা বই ও নগদান বইয়ে হালনাগাদ কোন তথ্য নেই। যা ইতিপূর্বে উপজেলা প্রশাসনের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানেও হিসাবের এ বেহাল অবস্থা বিরাজমান।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়- এ সমস্ত স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির অভিযোগে ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, সাধারণ শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সর্বসস্তরের জনসাধারণ ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নুর আহমদের অপসারণ ও পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তীব্র আন্দোলনের মুখে পরদিন ১৫ আগস্ট ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন নুর আহমদ। ওইদিন জ্যেষ্ঠতায় ক্রমিক দুই নূরুল হোসাইনকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার অর্পন করেন তিনি।

পরে ২০২৪ সালের ১৫ অক্টোবর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নূরুল হোসাইন জ্যেষ্ঠতার ক্রমিক তিন ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মফিজুল ইসলামকে অনাপত্তি পত্র প্রদান করেন এবং তাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বসহ আয়ন-ব্যয়ন ক্ষমতা নেয়ার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদনের পরামর্শ দেন।

অভিভাবকরা জানান- জেলার সর্বপ্রাচীন এই বিদ্যালয়ে ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও পড়ালেখা দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। যা নিয়ে বিদ্যালয়ের অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা চরম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও হতাশায় ভুগছে। বৃহত্তর স্বার্থে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) নুর আহমদকে অবিলম্বে অপসারণ করে প্রশাসনিকভাবে সকল প্রকার অনিয়ম-দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষী সাব্যস্তসহ পর্যাপ্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে সরকারিভাবে প্রধান শিক্ষক/সহকারী প্রধান শিক্ষক না আসা পর্যন্ত জ্যেষ্ঠ্যতায় ক্রমানুসারে পরবর্তীজনকে অস্থায়ীভিত্তিতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার প্রদান করতে হবে।


এদিকে ২০২৩ সালের ৬ জুন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নুর আহমদের তথ্য গোপন, স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠান- তৎকালীন রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাহমিদা মুস্তফা। যার স্মারক নং: ০৫.২০.২২০০.১২৭.০৮.০১১.২৩-৩৯৮। ওই প্রতিবেদনে ইউএনও ফাহমিদা মুস্তফা উল্লেখ করেন- ১নং ক্রমিকের সহকারী শিক্ষক নূরুল হোসাইনকে ডিঙিয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের পদ দখল করেন নুর আহমদ। তাঁর দায়িত্বকালীন সময়ে জাতীয় দিবসগুলি যথাযথভাবে পালন করা হয়নি। তাছাড়া মহান স্বাধীনতা দিবসে স্কুলের শিক্ষর্থীরা কোনরূপ ডিসপ্লে প্রদর্শন করেনি। ২০২৩ সালে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে কোন ধরণের শিক্ষার্থী, যোগ্য শিক্ষকদের মাপকাঠি নির্ণয়ের জন্য কোন ধরণের প্রতিযোগী প্রেরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। বিদ্যালয়ের আইসিটি ল্যাব ও কম্পিউটার ল্যাবের কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নুর আহমদের সরকারী অর্থ ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা, সরকারের আয়ন ব্যয়ন ও জনবল ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত ঘাটতি রয়েছে। বিদ্যালয়ে অভ্যন্তরীন রাজনীতি ও পারিপার্শ্বিক অসহযোগিতামূলক আচরন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ও সহকর্মীদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের অভাব সর্বোপরি দক্ষ নেত্বত্বের কারণে ঐতিহ্যবাহী এই স্কুলের আইন শৃঙ্খলাসহ পড়া লেখার মানের যথেষ্ট অবনতি হচ্ছে। সরকারি একজন প্রধান শিক্ষক নিয়োগ/পদায়নের মাধ্যমে অত্র বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বৃদ্ধির সহায়ক হবে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রামু খিজারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নুর আহমদ নিজেও বিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি ভালো নেই বলে মন্তব্য করেন। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন- এটা জানতে হলে স্কুলে যেতে হবে। এছাড়াও অন্যান্য অনিয়মের বিষয়ও তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান। বিদ্যালয়ে নিয়মিত আয়-ব্যয়ের হিসাব না থাকার বিষয়েও তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন কার্ডসহ বিভিন্ন ভুল সংশোধন প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান তিনি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রামু উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার নুরুল ইসলাম জানিয়েছেন- রামু খিজারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিস্থিতি মোটেও ভালো নেই। বিদ্যালয়ে আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা নেই। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের অদক্ষতার কারণে এসব পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও সবসময় দলাদলিতে জড়িয়ে পড়ে। যে কারণে বিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। সম্প্রতি তিনি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নির্দেশে বিদ্যালয়ে সৃষ্ট এসব অনিয়ম তদন্ত করেছেন। তদন্তে যে সব অনিয়ম ও সমস্যা চিহ্নিত হবে তা শীঘ্রই সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হবে।

রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও রামু খিজারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. রাশেদুল ইসলাম জানিয়েছেন- ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের অবহেলা, অদক্ষতার কারণে এ বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। বিদ্যালয়ের যাবতীয় অনিয়ম-দুর্নীতি ও অন্যান্য অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে। পবিত্র রমজান মাসের মধ্যে বিদ্যালয়ের বিরাজমান এসব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হবে।

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW