মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করা প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকার। শেরপুরের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরাও নিজ মাতৃভাষায় পড়তে চায়। সরকার কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে তাদের ভাষায় বই দিলেও তা পড়ানোর মতো কোনো শিক্ষক নেই। তাই নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য বিদ্যালয়ে নিজ ধর্মের শিক্ষক চায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা।
সীমান্তবর্তী শেরপুর জেলার শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার বিশাল এলাকাজুড়ে অবস্থিত গারো পাহাড়। এ পাহাড়ি এলাকাসহ পুরো জেলায় গারো, কোচ, হাজং, বানাই, হদি ,বর্মণ ও ডালু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির মানুষের বসবাস। এসব গোষ্ঠীর মানুষের রয়েছে আলাদা আলাদা ভাষা, আছে নিজস্ব সংস্কৃতিও। নিজ ভাষায় কথা বলাসহ সামনে এগোতে চান তারা। কিন্তু চর্চা আর সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্তির পথে তাদের মাতৃভাষা। পরিবারের সুখ-দুঃখের গল্প মাতৃভাষায় করলেও এসব জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভবিষ্যৎ স্বপ্নের পথে এগিয়ে যেতে হয় বাংলা ভাষার হাত ধরেই। তাই দিন দিন তাদের মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়ায় আক্ষেপ ফুটে উঠেছে। বয়োজ্যেষ্ঠদের অভিযোগ, তাদের ভাষার চর্চা না থাকায় এখন বাংলা ভাষার মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের মাতৃভাষা।
গারো পাহাড়ে বসবাসরত হাজং, বানাই ও ডালু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা প্রায় বিলুপ্তির পথে। আর গারো ও কোচ ভাষা কোনোমতে পরিবার পর্যন্ত টিকে আছে। নিজের ভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা। বিশেষ করে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় লেখা বই থাকলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের অভাবে সেগুলো পড়ানো সম্ভব হচ্ছে না কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। ফলে তারা আধো আধো ভাষায় কথা বলতে পারলেও ওই ভাষায় পড়তে ও লিখতে পারছে না।
প্রলয় হাজং বলেন, ‘আমাদের আগের লোকজনরা হাজং ভাষায় কথা বলতে পারলেও আমরা এখন পারি না। কারণ বিদ্যালয়ে আমরা তো বাংলা ভাষা শিখে বড় হয়েছি। আমরা চাই সরকার বিদ্যালয়গুলোতে আমাদের ভাষায় শিক্ষাদান চালু করুক।’
সুকেন্দ্র চন্দ্র ডালু বলেন, ‘আমাদের ডালু গোষ্ঠী তো এখন হারিয়ে গেছে। আমরা কয়েকটা পরিবার আছি, কিন্তু ভাষা হারিয়ে গেছে। কেউ এখন ডালু ভাষায় কথা বলতে পারি না।’
ঝিনাইগাতীর রাংটিয়ার সোনে নকশি কোচ পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, শতাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এমন আরও অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে পাহাড়ি এলাকাগুলোতে। এসব প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। এ বিদ্যালয়সহ ও অন্যান্য প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব বর্ণপরিচয়, চর্চা ও লেখাপড়ার সুযোগ না থাকায় দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে তাদের মাতৃভাষা। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা তাদের ভাষায় পড়তে চায় ও শিক্ষক চায় ।
সোনে নকশি কোচ পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী শুভশ্রী কোচ জানায়, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী আমরা, বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় পড়ি। আমাদের ভাষা শেখায় না। আমরা সরকারের কাছে আমাদের ভাষা শিখতে চাই। আমাদের ভাষার বই চাই, শিক্ষক চাই।’ চতুর্থ শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী ষষ্ঠিনা কোচ জানায়, ‘আমাদের বিদ্যালয়ে কোচ ভাষায় পড়ায় না। খালি বাংলা পড়ায়। তাই আমরা আমাদের মায়ের ভাষা বলতে পারি না, লিখতে পারি না। আমরা চাই সরকার আমাদের ভাষার বই দিক, শিক্ষক দিক।’ পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী গৌরব হাজং ও মহিমা হাজং জানায়, ‘আমাদের বাড়িতে হাজং ভাষায় কথা বলি। কিন্তু স্কুলে বাংলা ভাষায় কথা বলতে ও পড়তে হয় । এতে আমাদের খুব সমস্যা।’
জানা গেছে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য নিজস্ব ভাষায় বই প্রকাশে ২০১০ সালে আইন প্রণীত হয়। সে অনুযায়ী প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের জন্য ছয়টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভাষায় বই প্রণয়ন করে। সেগুলো হলো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল ও সাদ্রি ভাষা। তবে এসব ভাষার বই পড়ানোর জন্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি বিদ্যালয়গুলোতে। ফলে বইগুলো শিশুদের কোনো কাজেই আসছে না।
কোচ কালচারাল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক যুগল কিশোর কোচ বলেন, আমাদের কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষার বই থাকলেও শিক্ষক না থাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বইগুলো পড়ানো যাচ্ছে না। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাষার শিক্ষক না থাকায় বিপাকে এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এতে করে বাংলা ভাষা পড়াতে ও বাংলা ভাষার সাথে তাদের পরিচয় করাতে অনেক সময় লেগে যায়। এতে হিমশিম খেতে হয় শিক্ষকদের। আমরা চাই আমাদের জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হোক। প্রতিটা জাতিগোষ্ঠীর এলাকার বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা পড়তে সমস্যা হয়। আমরা চাই পাহাড়ি এলাকায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের নিজস্ব ভাষার শিক্ষক ও বই যেন দেয়া হয়। এতে করে আমাদের জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা টিকে থাকবে। শেরপুরে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাষার সঙ্গে তাদের সংস্কৃতিও হারিয়ে যাচ্ছে। ভাষা ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে একটি কালচারাল একাডেমি খুব জরুরি।’
সোনে নকশি কোচ পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকা হালিমা খাতুন বলেন, ‘আমরা যখন শিশু শ্রেণিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শিক্ষার্থী ভর্তি করি, তখন আমাদের খুব সমস্যা হয়। তারা আমাদের ভাষা বুঝতে পারে না আমরা তাদের ভাষা বুঝি না। এতে করে আমাদের যেমন সমস্যা তেমনি তাদের পড়াতেও আমাদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে অনীহা প্রকাশ করে।’
ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশরাফুল আলম রাসেল বলেন, ‘এ উপজেলাগুলোতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজনের বসবাস বেশি। তাদের জীবনযাত্রায় যেমন বৈচিত্র রয়েছে , তেমন বৈচিত্র রয়েছে তাদের ভাষায় । তারা পরিবারের সাথে নিজস্ব ভাষায় ভাব বিনিময় করে থাকেন। এ ভাষাগুলো আমাদের ঐতিহ্য। সেগুলো সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের এগিয়ে আসতে হবে ,পাশাপাশি বাংলা একাডেমিসহ অনান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে অবহিত করা হবে।’