৩’শ গুলির স্প্লিন্টার শরীরে বহন করে চলছে ভূঞাপুরের সুজন

এফএনএস (সৈয়দ সরোয়ার সাদী রাজু; ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল) : | প্রকাশ: ১ মার্চ, ২০২৫, ০১:৩৪ পিএম
৩’শ গুলির স্প্লিন্টার শরীরে বহন করে চলছে ভূঞাপুরের সুজন

জুলাই বিপ্লবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে ৩’শ গুলির স্প্লিন্টার শরীরে বহন করে দূর্বিসহ জীবনযাপন করছে  টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার অলোয়া ইউনিয়নের আকালু গ্রামের মৃত আনছার আলীর ছেলে সুজন (৪৪)। বাবার তিন সন্তানের মধ্যে একমাত্র বড় ছেলে সুজন। প্রাইমারিতে পড়াশোনা অবস্থায় ৩০ বছর আগে বাবাকে হারায় সে। তারপর থেকেই কঠিন জীবন পরিচালনা করতে হয় তাকে। পরিবারের হাল ধরতে প্রাইমারির পড়াশোনা বন্ধ করে রিকশা চালানোর উদ্দ্যোশে পারি জমায় রাজধানী ঢাকায়।

সুজন ঢাকায় রিকশা চালনার পাশাপাশি স্থানীয় শ্রমিক দলের রাজনীতিতে জড়িত ছিল। সে ভূঞাপুর উপজেলার অলোয়া ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ঢাকায় থাকাকালীন সময়ে সে বিএনপির একজন কর্মী হিসেবে বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নিতো। সম্প্রতি সে রিকশা চালানো ছেড়ে দিয়ে ঢাকার বাড্ডা এলাকায় ভাড়ায় সিএনজি চালাতো এবং সুযোগ করে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার পতনের আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করতো।

তারই ধারাবাহিকতায়, একদিন সিএনজি না চালালে যার চুলো জ্বলবে না, তা জেনেও সে গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ঢাকার বাড্ডা থানা ঘেড়াও কর্মসূচিতে সকাল ৯টায় অংশ গ্রহণ করে। সকাল ১০ টার দিকে পুলিশ আন্দোলনকারীরদের উপর গুলি বর্র্ষণ শুরু করে। পুলিশের গুলিতে তার পাশেই এক আন্দোলনকারী মাটিয়ে লুটিয়ে পড়লে সুজন তাকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে যায়। এর মধ্যেই পুলিশের ছররা গুলি এসে সুজনের শরীরে লাগে। গুলি লাগার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই সে অচেতন হয়ে পাশ্ববর্তী একটি দেয়ালের পাশে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত পড়ে থাকে। রাস্তাগুলোতে পুলিশের গোলাগুলি চলমান থাকায় তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পরে বিকেল ৪ টার দিকে তিনটি বাসার তিনটি দেয়াল ভেঙে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে আফতাব নগর নাগরিক হাসপাতাল, পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, সেখানেও অতিরিক্ত হতাহতদের চিকিৎসার কারণে তাকে ভর্তি করা হয়নি। 

পরে ঢাকা থেকে এনে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাত ৩টার দিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে ১২দিন চিকিৎসা করেও কোনো উন্নতি না হওয়ায় ভূঞাপুর উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় সিএমএইচ ঘাটাইলে চিকিৎসা নেয় সে। সেখানে ১৫দিন চিকিৎসার পরে তার শরীর থেকে ৩৯টি গুলি বের করা হয়। কিন্তু শরীরের প্রচন্ড ব্যাথা ও ফুলা না কমায় থেরাপি দেওয়ার জন্য ঢাকার ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে এক মাসেরও বেশি সময় চিকিৎসা নেয় সুজন। কিন্তু এখনো সে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে না। তার শরীরে এখনো প্রায় আড়ই’শ গুলির স্প্লিন্টার রয়েছে। ফলে সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। ক্রাচে ভর দিয়ে একটু-আধটু হাঁটতে পারলেও পরোক্ষণে তার শরীরে ব্যথা বেড়ে যায় এবং লোহার মতো শক্ত হয়ে যায়। তার শরীর স্বাভাবিক না হওয়ার কারণে আহত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো কাজ করতে পারছে না। ফলে তার পরিবারটি অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে। 

আহত সুজনের স্ত্রী নূপুর বলেন, “আমি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে, আমার বাবাও নেই। আমার স্বামী আহত হওয়ার দিন ৫ আগস্ট আমার সংসারে একটি টাকা ও কোনো খাদ্য সামগ্রী ছিল না। খবর পেয়ে আমার বাবার বাড়ি বরিশালের বিভিন্ন জনের সহযোগিতায় ৮০০ টাকা সংগ্রহ করে স্বামীকে উদ্ধার করার জন্য ঢাকায় যাই। ওর আহত হওয়ার পর থেকে সংসারে কোনো আয় নেই। বর্তমানে আমার শ্বশুড় বাড়ি এলাকার বিভিন্ন জনের কাছ থেকে হাত পেতে চেয়ে চিন্তে খেয়ে না খেয়ে জীবন পাড় করছি। এমনো দিন যাচ্ছে চুলায় আগুন জ্বলে না। এমন অবস্থায় আমার ৩ সন্তানের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এবং কি আমার স্বামীসহ প্যারালাইসড শ্বাশুড়ির খাবার ও ঔষধও যোগাড় করতে পারছি না। সম্পদ বলতে আমাদের আছে বাড়ির মাত্র ৩ শতাংশ জায়গা। সেখানে জরাজীর্ণ ১৬ হাতের একটি কাঁচা ঘরে শ্বাশুড়ি, আমরা স্বামী-স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে খুব করুণ অবস্থায় থাকি। মেরামতের অভাবে ঘরটিও যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। উপজেলা থেকে আমরা কিছু সাহায্য পেয়েছিলাম যা আমাদের বেশ উপকার হয়েছে। এ অবস্থায় আমাদের শুধু বেঁচে থাকার জন্য সকলের সাহায্য কামনা করছি”।

আহত সুজন বলেন, “আমার মৃত বাবাও একজন প্রতিবাদী লোক ছিল। আমি দরিদ্র লোক হলেও অন্যায় অত্যাচার অবিচার সহ্য করতে পারি না। ৫ আগস্টের আগেও আমি অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিছিল মিটিংয়ে অংশ গ্রহণ করেছি। আমি বিএনপির একজন কর্মী। জুলাই বিপ্লবের আন্দোলনে অন্যদিনের মতো ৫ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে বাড্ডা থানা ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণ করি। সকাল ১০ টার দিকে পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ শুরু করে। পুলিশ আমাদের উপর একতরফা গুলি বর্ষণ করে। এক পর্যায়ে পুলিশের ছররা গুলির ২’শ ৯৬টি স্পিন্টার আমার শরীরে লাগে। আমি অচেতন অবস্থায় দেয়ালের পাশে পড়ে থাকি। পরের দিন সকালে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমার জ্ঞান ফিরে। আমার শরীরে এখনো প্রায় আড়ই’শ গুলির স্প্লিন্টার রয়েছে। যা শরীর থেকে বের করা প্রয়োজন। আমি চলাফেরা করতে পারি না। ক্রাচের মাধ্যমে একটু হাঁটলেও ব্যাথা বেড়ে যায় ও শরীর ফুলে শক্ত হয়ে যায়। এমন অবস্থায় আমার উন্নত চিকিৎসা ও আর্থিক সহযোগিতা দরকার। আমার বিকাশ নম্বর ০১৯২১ ৬৯৪০৯১ এবং সোনালী ব্যাংক ভূঞাপুর শাখায় সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর- ৬০০৩৮০১০২২৩৫৩ উক্ত দু’টি মাধ্যমে আমাকে আর্থিক সহযোগিতা করার জন্য সকলের প্রতি দাবী জানাচ্ছি”।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোছা. পপি খাতুন বলেন, “জুলাই বিপ্লবে এ উপজেলায় একজন নিহত ও তালিকামতে ১৬ জন আহত রয়েছে। নিহত ও আহতদের পরিবারকে সরকারি ও ব্যক্তিভাবে সহযোগিতা প্রদান করে আসছি। সরকারিভাবে এখনো আহতের কর্মসংস্থানের কোনো নির্দেশ আসেনি। তবে, আহত পরিবারগুলো যাতে কোনো সমস্যায় না পড়ে সে ব্যাপারে প্রশাসন ও সমাজসেবা কাজ করছে”।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে