শেরপেুরের চাষিরা সরিষা চাষ করে লাভবান হওয়ার দিনদিন চাষের পরিধি বাড়ছে। জেলার সদর, শ্রীবরদী ও নকলা উপজেলার কৃষি জমিগুলো সরিষা চাষের জন্য বেশ উপযোগী। তবে এখন বাড়তি যোগ হয়েছে সরিষা খেতে মৌচাষ। এতে একদিকে মৌমাছির মাধ্যমে সরিষা ফুলের পরাগায়নের সহায়তায় সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে মৌচাষিরা পর্যাপ্ত পরিমাণ মধু সংগ্রহ করতে পারছেন। ফলে সমন্বিত এই চাষে লাভবান হচ্ছেন সরিষা ও মৌচাষি উভয়ই। জেলায় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এ পদ্ধতিতে সমন্বিত চাষ।
শেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ কর্মসূচির আওতায় ২০২৩-২০২৪ মৌসুমে ১৮ হাজার ৭ শ ৬১ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়। আবহাওয়া অনুকূলে ও ভালো ফলন হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ১৯ হাজার ৬৮ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। এদিকে, জেলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে প্রায় দুই শতাধিক মৌ চাষি এসেছেন।
কৃষি বিভাগ আরও জানায়, জেলায় সমতল ভূমির পরিমাণ বেশি। একারণে এক জমিতে একই ফসল বারবার চাষ করলে জমির উর্বরতা হারায়। সেকারণে জমির উর্বরতা বাড়াতে সরিষা চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। এ অঞ্চলের কৃষকরা উচ্চ ফলনশীল ও স্থানীয় উভয় জাতের সরিষা চাষ করেন। দুই জাতের সরিষা নভেম্বরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আবাদ করতে হয়। ফসল ঘরে উঠতে সময় লাগে জাত ভেদে ৭০ থেকে ৯০ দিন। বর্তমানে শেরপুরের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন সরিষা ফুলের সমারোহ। চলতি বছর ২০২৩-২৪ রবি মৌসুমে জেলায় উচ্চ ফলনশীল জাতের টরি-৭, বারি সরিষা- ৯, বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৭ এর চাষ বেশি হয়েছে। এ বছর ২৯ হাজার ৫৫০ মেট্রিক টন সরিষা উৎপাদন হবে। যার বাজার মূল্য ১৮৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা। আর এবছর যে পরিমাণ সরিষা উৎপাদন হবে তা জেলার শতকরা ৭০ ভাগ তেলের চাহিদা পূরণ করবে।
এখানকার কৃষকদের মাঝে একসময় একটা ভুল ধারণা ছিল যে, সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌ বাক্স স্থাপন করলে সরিষার ক্ষতি হয়। আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ সেবার মাধ্যমে এ ভুল ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে সহযোগিতা করেছেন। কৃষকরা এখন বুঝতে পেরেছেন যে, সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌ বাক্স স্থাপন করলে সরিষা উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। তাই শেরপুরে সরিষা চাষিরা বর্তমানে মৌচাষিদের বাক্স স্থাপনের জন্য সহযোগিতা করছেন।
নকলা উপজেলার চর বাছুর আলগা গ্রামের কৃষক শাহজাহান আলী বলেন, আমাদের চন্দ্রকোনা, নারায়ণখোলাসহ এ চরাঞ্চলের জমিগুলো সরিষার স্বর্গভূমি। এখানে প্রত্যেক মৌসুমে সাতক্ষীরা, খুলনার মৌ চাষিরা এসে মধু সংগ্রহ করেন। কিন্তু আমরা মধু সংগ্রহ করতে পারি না। আমাদের কিনে খেতে হয়। কৃষি অফিস যদি আমাদের মৌ চাষের প্রশিক্ষণ দিতো, তাহলে আমরা সরিষার সঙ্গে মৌ চাষ করে অনেক বেশি লাভবান হতাম। আমি মৌ চাষের প্রশিক্ষণের দাবি জানাচ্ছি।
শ্রীবরদী উপজেলার ভেলুয়া ইউনিয়নের লংক্ষিডাংড়ি গ্রামে মৌ বাক্স বসিয়েছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ছাইফুল ইসলাম। তিনি জানান, ৩ বছর আগে থেকে শেরপুরের নকলায় ৫০টি বাক্স দিয়ে এ অঞ্চলে মৌচাষ শুরু করেন। বর্তমানে তিনি এখানে ২০০টি বাক্স বসিয়েছেন। গত বছর তার আয় ছিল প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। এ বছরও তিনি তেমনি আশা করছেন।
সদর উপজেলার চরশেরপুর ইউনিয়নের যোগিনীবাগ গ্রামের চাষি রুবেল মিয়া জানান, ইতোমধ্যে আমাদের এ মাঠে সরিষা কাটা ও মাড়াই শুরু হয়েছে। আমন ধান কাটার পর পতিত জমিতে সরিষা চাষ একটি লাভজনক ফসল। জাত ভেদে সরিষা চাষে বিঘা প্রতি খরচ ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা। বিঘা প্রতি ফলন ৫ থেকে ৭ মণ এবং মণপ্রতি সরিষার বাজারদর ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। খরচ বাদে বিঘায় লাভ হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। এ বছর আমি চার বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছি।
শেরপুর বিসিক শিল্প নগরীর উপ ব্যবস্থাপক বিজয় কুমার দত্ত জানান, বিসিক শিল্প নগরীতে নিয়মিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌচাষের প্রশিক্ষণ দিয়ে আগ্রহীদের ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থাও করা হয়।
শেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, গত বছরের তুলনায় শেরপুর জেলার সরিষার আবাদ বেড়েছে। মোট সরিষার আবাদ হয়েছে ১৯ হাজার ৬৮ হেক্টর জমিতে। আমরা কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বীজ ও সার বিতরণ করেছি। চলতি বছর শেরপুরে কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় জেলার প্রায় ৫০ হাজার কৃষককে বিনামূল্যে রাসায়নিক সার এবং সরিষা বীজ প্রদান করা হয়েছে। আর মৌমাছি সরিষার ফুলে উড়ে উড়ে বসে মধু সংগ্রহ করে। এতে সরিষা ফুলে সহজে পরাগায়ন ঘটে। তাই সরিষাক্ষেতের পাশে মৌ চাষের বাক্স স্থাপন করলে সরিষার ফলন প্রায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এতে একদিকে মৌচাষিরা যেমন মধু আহরণ করে লাভবান হতে পারেন, অন্যদিকে সরিষা চাষিরাও লাভবান হতে পারছেন।