এই শহরে রাত গভীর হলে শুধু পথঘাট নয়, অগণিত মানুষের হৃদয়ও আতঙ্কে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ধর্ষণের বর্বরতা কি কেবল রাতের আঁধারেই ঘটে? না, এই পাশবিকতা দিনের আলোতেও ঘটে, জনসমাগমের ভিড়েও ঘটে, এমনকি চার দেয়ালের মধ্যেও ঘটে। পত্রিকার পাতায় ধর্ষণের খবর আজ আর ব্যতিক্রম নয়, বরং যেন নিত্যদিনের এক স্বাভাবিক সংবাদ। মানুষ আজকাল আর হতবাক হয় না কেবল চোখ বুলিয়ে যায় শিরোনামের ওপর দিয়ে, যেন এটি এক প্রচলিত নিয়ম মাত্র।
ধর্ষণ কি কেবল নারীদের অভিশাপ? না, এই ভয়াবহতার শিকার হয় শিশুরাও নিষ্পাপ, অবুঝ একরত্তি শিশুরা, যারা এখনো পৃথিবীর নিষ্ঠুরতার সংজ্ঞা বোঝে না। কারও দুচোখের তারা, কারও কোলজুড়ে আসা আশার আলো, সেই শিশুরাও রেহাই পায় না কিছু বিকৃত মস্তিষ্কের হিংস্রতা থেকে। এক মাসের নবজাতকের বাবাও আজ আতঙ্কে ঘুমোতে পারেন না, ঠিক যেমন ঘুমাতে পারেন না এ দেশের কোন মেয়ের বাবা, স্ত্রীর স্বামী, কিংবা বোনের ভাই।
আমরা সভ্যতার কথা বলি, উন্নয়নের জয়গান গাই, কিন্তু যে সমাজে নারীর চলার পথ অনিরাপদ, যেখানে শিশুর নিষ্পাপ হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকে ভয়, সেখানে এই সভ্যতা এক নির্মম প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়। ধর্ষণ শুধু একটি শারীরিক আক্রমণ নয়, এটি মানুষের পশুবৃত্তির নগ্ন প্রকাশ, নৈতিকতার অপমৃত্যু। এটি একটি সভ্যতার ব্যর্থতা, যেখানে অপরাধী বুক ফুলিয়ে ঘোরে, আর সম্ভ্রম হারানো মেয়েটি সমাজের ভ্রুকুটির সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়ায়।
প্রতিবার ধর্ষণের ঘটনার পর শাস্তির দাবি ওঠে, মিছিল হয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় ওঠে, কিন্তু তারপর? কিছুদিন পর সব আবার আগের মতোই পত্রিকায় নতুন কোনো শিরোনাম আসে, আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই, প্রতিবাদের আগুন নিভে আসে। এভাবে কি বদলাবে কিছু?
বদলাতে হবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। নারীর পোশাক নয়, পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। শিশুকে সাবধান করতে নয়, অপরাধীকে থামাতে হবে। কঠোর আইন প্রণয়ন ও তার নির্ভুল প্রয়োগের পাশাপাশি, বদলাতে হবে সমাজের মানসিকতা। ধর্ষকের শাস্তি কেবল ফাঁসি বা কারাবাসেই সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না, তাকে ঘৃণার প্রতীক বানাতে হবে, যেন সমাজ তাকে প্রত্যাখ্যান করে, যেন অপরাধ করার আগে সে হাজারবার ভাবে।
এই লড়াই শুধু নারীদের নয়, শুধু ভুক্তভোগীদের নয় এটি পুরো সমাজের লড়াই। আমাদের একসঙ্গে রুখে দাঁড়াতে হবে, এক মুহূর্তের জন্যও এই ভয়ংকর বাস্তবতাকে স্বাভাবিক ভাবা চলবে না। ধর্ষণের আতঙ্কে রাত জাগা সমাজের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন এমন একটি সমাজ, যেখানে নারী, শিশু, সবাই নিরাপদে নিশ্বাস নিতে পারে, যেখানে পিতারা রাতভর দুশ্চিন্তায় জাগবেন না, বরং নিশ্চিন্তে ঘুমাবেন এই বিশ্বাসে যে তাদের মেয়ে, তাদের বোন, তাদের শিশু নিরাপদ। তবেই সত্যিকার অর্থে আমরা বলতে পারবো আমরা সভ্য হয়েছি।
কবে শেষবার কোনো ধর্ষকের এমন শাস্তি কার্যকর হতে দেখেছি, যা দেখে অন্য এক ধর্ষক কেঁপে উঠবে? কবে শেষবার এমন ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা দেখে সমাজে নতুন সূর্যের জন্ম হয়েছে? আমি মনে করতে পারি না। হয়ত আমার স্মৃতিশক্তি দুর্বল, অথবা হয়ত এমন কিছু ঘটেনি বলেই আমার মনে নেই।
আমরা শুনেছি, আইনের শাসন আছে। আমরা শুনেছি, ধর্ষকের বিচার হবে, কঠোরতম শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু কই, সে কঠোরতা? কই সে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি, যা দেখে অপরাধী এক মুহূর্তের জন্য হলেও থমকে দাঁড়াবে? বরং আমরা দেখি বছরের পর বছর বিচারপ্রক্রিয়ার জটিলতায় আটকে থাকা ফাইলের স্তূপ। ক্ষমতাশালী অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয়, আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাওয়ার ধূর্ত কৌশল।
আমরা এক নতুন ভোরের প্রতীক্ষায় আছি? যে ভোরে ন্যায়বিচার শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, বরং বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি হবে! সময়ের স্রোতে সমাজ বদলায়, শাসকের হাত ধরে আসে নীতি-নিয়মের সংস্কার। আজ, যখন পৃথিবীর বহু প্রান্তে নারী অধিকার নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হচ্ছে সভ্যতা, তখন আমাদেরও সময় হয়েছে নির্ভয়ে, দ্বিধাহীন কণ্ঠে একটি সংস্কারের দাবি তোলার এমন এক সংস্কার, যা নারীর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবে, যা দানবদের মনে ভয় জাগাবে, যা ধর্ষণ নামক ভয়ংকর অভিশাপকে শেকড় থেকে উপড়ে ফেলবে।
একটি সমাজ তখনই সত্যিকারের সভ্য হয়, যখন সেখানে নারীর চলার পথ কণ্টকমুক্ত হয়, যখন সে জানে কোনো অন্যায় স্পর্শ তাকে কলঙ্কিত করতে পারবে না, যখন সে নিশ্চিত থাকে তার সম্ভ্রমের কেউ হাত বাড়ালে, রাষ্ট্র তার প্রতিরক্ষায় বজ্র কঠোর হবে। তাই, আজকের দিনে আমাদের একটাই দাবি ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠিনতম শাস্তির আইন, এমন আইন যা হবে দ্রুত কার্যকর, যা হবে ভয়ংকর দৃষ্টান্তমূলক। আমরা চাই, ধর্ষকের বিচার যেন হয় সর্বোচ্চ কঠোরতার সঙ্গে, যেন এক মুহূর্তও বিলম্ব না হয়। প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কিংবা এমন কঠিন শাস্তির বিধান চাই, যা দেখে আর কেউ নারীর প্রতি পাশবিকতা চালানোর সাহস পাবে না। আজ যদি এই সংস্কার হয়, তবে তা হবে নারীদের জন্য প্রকৃত উপহার শুধু এক দিনের জন্য নয়, চিরকালীন নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি।
শান্তির প্রতীক, বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূস যখন বর্তমান সরকারের কাণ্ডারি। ইতিহাসের বাঁকে দাঁড়িয়ে তিনি শুধু একজন নেতা নন, বরং এক আদর্শের প্রতীক, এক নতুন দিগন্তের স্বপ্নদ্রষ্টা। তখন ন্যায়ের জন্য আর কোনো শর্ত থাকতে পারে না। কোনো ‘যদি’ বা ‘কিন্তু’ নয়, আজই চাই ধর্ষক নিধন আইন। একবার যদি এই সংস্কার প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে এক নতুন ভোরের সূচনা হবে যেখানে নারী সাহস নিয়ে পথ চলবে, নিরাপদে শ্বাস নেবে, আর ধর্ষকের অভিশাপ সমাজ থেকে চিরতরে মুছে যাবে। সমাজ বদলাতে পারে একটি সিদ্ধান্তেই, একটি সঠিক সংস্কারেই।
আরেকটি কথা সমাজ পরিবর্তন কেবল সরকার নির্ভর নয়; এ পরিবর্তনের কাণ্ডারি হতে হবে আমজনতাকেও। প্রত্যেক নাগরিকের মধ্যে দায়িত্ববোধ জাগ্রত হলেই কেবল সত্যিকার অর্থে ন্যায়ের সমাজ গড়ে ওঠে। সংস্কারের যাত্রা যদি একদিকে সরকার পরিচালিত হয়, তবে অপর দিকে জনগণের অংশগ্রহণই সেটির সফলতার মূল চাবিকাঠি।
তাই, আমরা প্রত্যাশা করি এই সরকার, যার মূল ভিত্তি জনগণের আত্মত্যাগ, তারা দেশকে সত্যিকার ন্যায়বিচার ও শান্তির পথে পরিচালিত করবে। আমরা স্বপ্ন দেখি, আজকের এই পরিবর্তন কেবল একটি মুহূর্তের নয়, বরং তা হবে এক অবিরাম অভিযাত্রা একটি নতুন ভবিষ্যতের পথে, যেখানে নারী পুরুষ শিশু প্রতিটি মানুষ সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারবে, যেখানে সমাজের প্রতিটি স্তরে সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।
আসুন, আমরা সবাই মিলে এই অভিযাত্রায় শরিক হই, পরিবর্তনের শপথ নিই, এক নতুন সূর্যের প্রত্যাশায় এগিয়ে চলি।
লেখক : মুসফিকুর রহমান সুভ; সাংবাদিক ও কলামিষ্ট