নতুন রূপে সরাইলের ত্রিতাল সংগীত নিকেতন

এফএনএস (মাহবুব খান বাবুল; সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) :
| আপডেট: ১২ মার্চ, ২০২৫, ০৮:০১ পিএম | প্রকাশ: ১২ মার্চ, ২০২৫, ০৬:৫৭ পিএম
নতুন রূপে সরাইলের ত্রিতাল সংগীত নিকেতন

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে সাহিত্য ও সংস্কৃতি শিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান ত্রিতাল সংগীত নিকেতন। দীর্ঘ তিন যুগেরও অধিক সময় পর নতুন রূপ ধারণ করেছে ত্রিতাল। বাহিরে ভেতরে চকচক করছে। উপরে ফঁকফঁকা টিনের চাল। নবরূপে বিদ্যুতের আলোর ঝলকানি।  সব মিলিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেজবা উল আলম ভূঁইয়ার হস্তক্ষেপে নতুন রূপধারণ করেছে গত ৪২ বছর আলো ছড়িয়ে আসা এই প্রতিষ্ঠানটি। হাঁসি ফুটেছে কঁচি শিক্ষার্থীদের মুখে। ঝলমলে পরিবেশ পেয়ে স্বস্তি ফিরে এসেছে অভিভাবকদের মনে। অতীতের মত আবারও স্বাচ্ছন্দের সাথে গতিতে এগিয়ে চলছে সরাইলে সংস্কৃতি শিক্ষার ঐতিহাসিক পাদপীঠ ত্রিতাল। সাম্প্রতিক সময়ে উপজেলার সকল সরকারি বে-সরকারি অনুষ্ঠানেই ত্রিতাল অংশ গ্রহন করছে। ত্রিতাল প্রতিষ্ঠার সাথে নানা ঘটনা ও ইতিহাস জড়িত। ত্রিতালের অফিস ও অধ্যক্ষ সূত্র জানায়, সরাইল উপজেলা চত্বরের এক পাশে স্থাপিত শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারক বাহক ত্রিতাল গত ৪২ বছরের রং বদলে দিয়েছেন ইউএনও। এর আগে এটির অফিস ও পাঠদানের কক্ষ ঝরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল। দরজা জানালা ফ্লোর আর উপরের টিনের চালের অবস্থা ছিল বেহাল। বর্তমানে সংস্কারের ফলে বাহিরে ভেতরের চাকচিক্য আর ঝকমক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের অতীতের দূ:খ কষ্টকে ভুলিয়ে দিয়েছে। সংস্কার কাজটির সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন সরাইল সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল জব্বার। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি স্থাপিত এই প্রতিষ্ঠানটি ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাস থেকে নতুন রূপ ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। বাহির থেকে প্রতিষ্ঠানটির দিকে তাকালেই মন ভরে যায়। উপজেলার একমাত্র সংগীত শিক্ষালয়টি গত ৪২ বছর ধরে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২০ সহস্রাধিক ছেলে মেয়ে এই প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহন করেছে। তারা প্রত্যেকেই স্বস্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বল মহিমায় উদ্ভাসিত। প্রত্যেকেই আলো ছড়িয়ে চলছে নিজেদের অবস্থান থেকে। বর্তমানে ৭০-৮০ জন ছেলে মেয়ে ত্রিতালে অধ্যয়ন করছে। এখানে মূলত উচ্চাঙ্গ সংগীত বিষয়ের মূল ভিত্তিটা গড়ে দেয়া হয়। ফলে উচ্চাঙ্গ সংগীত, নজরূল রবীন্দ্র সঙ্গীত, ভাটিয়ালি, ভাওয়াল, দেশাত্ববোধক গান ও তবলা শিক্ষাসহ অন্যান্য গান শিক্ষা দেয়া হয়। ত্রিতালের শিক্ষার্থীরা উপজেলা সদর ছাড়াও জেলা, বিভাগ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তাদের কৃতিত্ব দেখিয়ে থাকে। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে ত্রিতালের শিক্ষার্থীরা বিটিভিতে ‘অভিযান’ নামের ত্রিশ মিনিটের একটি অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহন করে সাফল্য ও প্রতিভা প্রদর্শন করেছে। ফলে তারা বাংলাদেশ টেলিভিশনে দাওয়াত পায়। সেখানে তারা ‘নিবেদন’ নামের ২৫ মিনিটের আরেকটি আঞ্চলিক অনুষ্ঠানে সরাইলের ইতিহাস ঐতিহ্য সংবলিত গান গেয়ে স্থানীয় লোকজ সংস্কৃতি সুনিপুণভাবে তুলে ধরে সরাইলবাসীর মন জয় করতে সমর্থ হয়েছেন। এমন সব ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই নিজের শ্রম ঘামে ত্রিতালকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক গবেষক ও ত্রিতালের বর্তমান অধ্যক্ষ সঞ্জিব কুমার দেবনাথ।

যেভাবে যাত্রা শুরূ ত্রিতালের: 

১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় থেকেই উচ্চাঙ্গ সংগীত তথা সংগীত শিক্ষার মোহ ছিল সঞ্জিব কুমারের। কারণ ওই সময়ে তিনি প্রয়াত ওস্তাদ আব্দুর হামিদ, কান্তি চৌধুরী, নিরোদ বড়ুয়া ও মিহির লালের মত সংগীতজ্ঞদের কাছ থেকে সংগীতের তালিম নিয়েছেন। আর তখন থেকেই নিজ উপজেলা সদরে একটি সংগীত শিক্ষালয় গড়ে তোলার স্বপ্ন লালন করতেন সঞ্জিব কুমার। অনেক প্রচেষ্টা সভা সেমিনার চড়াই উৎড়াই ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে অবশেষে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে একাধিক সভা করে কালিকচ্ছ (দ:) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পার্শ্বে উপজেলা পরিষদ কর্তৃক সংগীত নিকেতনের একটি আধা-পাকা ঘর তৈরী করতে সক্ষম হন। এই কাজে সঞ্জীব কুমারকে সহযোগিতা করেছিলেন বিদ্যালয়ের এসএমসি’র তৎকালীন সভাপতি প্রয়াত ইব্রাহীম হোসেন ইদন মিয়া। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ ফেব্রূয়ারী ঘরটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ,কে,এম মহিউদ্দিন। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি নিকেতনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন উপজেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান লে: (অব:) ডা: মো. হারূন ইসলাম। কমিটির সিদ্ধান্তে অবৈতনিক শিক্ষক নিয়োগ পান সঞ্জীব কুমার দেবনাথ, নামমাত্র সম্মানীতে ইন্তাজ আলী, রঞ্জীব কুমার দেবনাথ ও মো. ছাদেক মিয়াকে নিয়োগ দেয়া হয়। তবলা বাদক পদে অবৈতনিক নিয়োগ পান কালীকচ্ছের খোকন চন্দ্র সেন। অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান আব্দুল হামিদ। এক সময় আব্দুল হামিদের আকস্মিক মৃত্যুর ফলে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ এপ্রিল তারিখে সঞ্জীব কুমারকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেয়া হয়। ভালোই চলতে থাকে নিকেতনটি। দিনদিন বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। কিন্তু হঠাৎ করে একটি মহলের বিরোধীতার কারণে সেখান থেকে নিকেতনটি স্থানান্তর করতে হয়। উপজেলা পরিষদের সিদ্ধান্ত মতে সংগীত নিকেতনটি বর্তমান সমাজসেবা অফিস সংলগ্ন জায়গায় স্থানান্তর করে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পুণ্যব্রত চৌধুরী উদ্বোধন করেন। সেই থেকে অদ্যাবধি এটি সুষ্ঠু সুন্দর ভাবে চলে আসছে। প্রতিবছরই অগণিত শিক্ষার্থী তাদের প্রশিক্ষণ শেষ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। ৪২ বছর ধরে অব্যাহত আছে এই প্রতিষ্ঠানের আলো ছড়ানো।

যাদের অবদানে ত্রিতাল: 

ত্রিতাল প্রতিষ্ঠায় শুরূ থেকে সরাইলের অনেক গুণী ব্যক্তিরা সহযোগিতা করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও জনপ্রতিনিধি। উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন- ডা: হারূন ইসলাম (প্রয়াত), অধ্যক্ষ শেখ মো. আবু হামেদ (প্রয়াত), আব্দুল হালিম (প্রয়াত), মো. ইদ্রিছ আলী, মো. হুমায়ুন কবীর, এ. আই মনোয়ার উদ্দিন মদন (প্রয়াত), মো. ছাদেক মিয়া, মো. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ (প্রয়াত), ঠাকুর মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ মিজান,  মো. আনিছুল ইসলাম ঠাকুর, সৈয়দ জিয়াউল হোসেন সানু, মো. আইয়ুব খান, জিয়াউদ্দিন ঠাকুর (প্রয়াত), মমিন হোসেন, মো. আনোয়ার হোসেন, এডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা ও এডভোকেট আবু বকর (প্রয়াত) প্রমূখ। অধ্যক্ষ সঞ্জীব কুমার দেবনাথ বলেন, ইউএনও মহোদয় সংস্কার করে দেয়ায় প্রতিষ্ঠানটির অনেক সুন্দর হয়েছে। এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তাই বর্তমান পরিসরে জায়গা সংকুলান হচ্ছে না। সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা মাদকসহ বিভিন্ন অপকর্ম থেকে ফিরিয়ে রাখে। শিশুর মানবিক গুণাবলী ও সুকুমার বৃত্তি গুলো ফুটিয়ে তুলে। পরিবার ও সমাজের প্রত্যেকটি শিশুর মন নতুন কিছু করতে বিকশিত হয়। উপজেলা পরিষদের প্রশাসক ও ত্রিতাল সংগীত নিকেতনের সভাপতি মো. মেজবা উল আলম ভূঁইয়া বলেন, পড়ালেখার পাশাপাশি প্রত্যেকটি শিশুর বিনোদনের প্রয়োজন রয়েছে। ত্রিতাল সরাইলের শিশুদের সেটা দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া উপজেলার সকল অনুষ্ঠানে ত্রিতালের শিশুরা সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়ে যাচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচিয়ে রাখা সরাইলের সকলের দায়িত্ব।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে