চাটমোহর ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে চাল লুট, দোষিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি

এফএনএস (হেলালুর রহমান জুয়েল; চাটমোহর, পাবনা) : | প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল, ২০২৫, ০৭:২৩ পিএম
চাটমোহর ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে চাল লুট, দোষিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি

পাবনার চাটমোহরে জিআর প্রকল্পের বরাদ্দকৃত চালের হরিলুট হয়েছে। ভুয়া কমিটি দাখিল করে চাল উত্তোলন করে তা কালোবাজারে বিক্রি করে অর্থ লোপাট করা হয়েছে। এসব প্রকল্প বা চাল উত্তোলনের বিষয়ে জানেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আবার একই ব্যক্তি একাধিক প্রকল্পের সভাপতি হিসেবে চাল উত্তোলন করে তা বিক্রি করে টাকা আত্মসাত করেছেন। এনিয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছেন এলাকাবাসী,জিআর প্রকল্পের চাল আত্মসাতকারীদের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য একাধিক মানববন্ধনও করা হয়েছে। মানববন্ধনে দোষিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে। অভিযোগ দেওয়া হয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে। বিএনপি’র স্থানীয় কিছু নেতা-কর্মী এসকল প্রকল্পের সাথে জড়িত বলেও অভিযোগ উঠেছে।

অভিযোগে জানা গেছে,চাটমোহরে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে জিআর চাল বরাদ্দ নিয়ে লোপাট করা হয়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে চাল উত্তোলন করা হলেও জানেন না প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ভুয়া কমিটি দাখিল করে চাল উত্তোলনের পর কালোবাজারে বিক্রি করে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। আবার এক ব্যক্তি একাধিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে চাল উত্তোলন করেছেন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন এলাকাবাসী। তাঁরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। একাধিক মানববন্ধনের ঘটনাও ঘটেছে। 

অভিযোগে আরো জানা গেছে,চাটমোহর উপজেলায় ১১৮টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে উন্নয়নকাজে জিআর প্রকল্পে প্রায় ১৪৪ মে,টন চাল বরাদ্দ দেয় জেলা প্রশাসন। তার মধ্যে ফৈলজানা,পার্শ্বডাঙ্গা,মূলগ্রাম ইউনিয়ন ও পৌরসভার বেশ কিছু মসজিদ-মাদ্রাসা,এতিমখানা ও মন্দিরের তালিকা অনুযায়ী খোঁজ নিয়ে দেখা যায়,ফৈলজানা ইউনিয়নের কুয়াবাসী আলহাজ মহির উদ্দিন হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার সভাপতি হিসেবে মোঃ ওমর আলী ২ মে.টন,কদমতলী মহিলা মাদ্রাসার সভাপতি হিসেবে তারিকুল ইসলাম ২ মে.টন,কুয়াবাসী আয়শা সিদ্দিকা মহিলা মাদ্রাসা ও এতিমখানার সভাপতি হিসেবে ইকবাল হোসেন আড়াই মে,টন,মিনাজমোড় জামে মসজিদ,চকমারম জামে মসজিদের সভাপতি হিসেবে আঃ রাজ্জাক পালন আড়াই মে,টন,কুয়াবাসী ঈদগাহ ময়দানের সভাপতি হিসেবে জাহিুল ইসলাম ২ মে,টন,,চকমারম বাসতালুক কুটিপাড়া সম্মিলিত ঈদগাহ ময়দানের সভাপতি হিসেবে মোস্তফা প্রাং ২ মে.টন,কদমতলী জামে মসজিদের নামে শামীম হোসেন ১ মে.টন,পরশ মাতাজির মাজার শরীফের                  ভাপতি হিসেবে জাহিদুল ইসলাম দেড় মে.টন,কুয়াবাসী মধ্যপাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ,কুটিপাড়া জামে মসজিদ,কদমতলী জামে মসজিদের নামে চাল বরাদ্দ নিয়ে আত্মসাত করা হয়েছে। এছাড়া মিনাজমোড় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ,কুয়াবাসী আয়শা সিদ্দিকামহিলা মাদ্রা ও আয়শা সিদ্দিকা মহিলা মাদ্রাসার কোন অস্তিত্ব নেই।  

এদিকে পবাখালী দক্ষিণপাড়া মহিলা হাফিজিয়া মাদ্রাসা,পবাখালী রোকেয়া নুরুল মাদ্রাসা,দেলোয়ারা সামাদ নুরানি কিন্ডারগার্টেন (মক্তব) এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি আব্দুস সামাদ এবং তাঁর ছেলে তৌফিক ইমাম পবাখালী নুরানি কিন্ডার গার্টেনের সভাপতি। এই চারটি প্রতিষ্ঠানে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সাড়ে ১০ টন। তাঁদের বাবা-ছেলের চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধু পবাখালী রোকেয়া নুরুল মাদ্রাসার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বাকি তিনটি প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব নেই। ভুয়া কমিটি তৈরি করে চাল উত্তোলনপূর্বক অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।

এদিকে দিঘুলিয়া হাসান হোসেন (রহ.) জামে মসজিদ এবং দিঘুলিয়া পুরোনো বড় জামে মসজিদের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম। এই দুটি মসজিদে বরাদ্দ পাওয়া গেছে সাড়ে ৪ টন। এর মধ্যে দিঘুলিয়া পুরোনো বড় জামে মসজিদের অস্তিত্ব নেই। ভুয়া কমিটি দাখিল করে চাল আত্মসাৎ করা হয়েছে।

এ ছাড়া মিনহাজ মোড় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও পবাখালী দক্ষিণপাড়া বাইতুল আমান জামে মসজিদের সভাপতি সাইফুল ইসলাম। এর মধ্যে মিনহাজ মোড় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের অস্তিত্ব নেই। এই দুটি প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ পেয়েছে সাড়ে ৫ টন চাল।

পবাখালী নতুন জামে মসজিদ ও পবাখালী দক্ষিণপাড়া জামে মসজিদের সভাপতি সাইফুল ইসলামের ভাতিজা মনিরুল ইসলাম। এর মধ্যে পবাখালী দক্ষিণপাড়া জামে মসজিদের নামে ভুয়া কমিটি দাখিল করে চাল উত্তোলন করা হয়েছে। ফরিদা শামসুল মহিলা হাফিজিয়া মাদ্রাসার সভাপতি সাইফুল ইসলামের ভাগনে আজিবর রহমান দেড় টন চাল বরাদ্দ পেয়েছেন। অথচ এই নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। পবাখালী লালন একাডেমির নামে দেড় টন চাল উত্তোলন করেছেন সভাপতি হিসেবে সরোয়ার হোসেন। অথচ এই নামে কোনো একাডেমি নেই। তবে এলাকায় একটি মাজার রয়েছে,যার সঙ্গে এটির সংশ্লিষ্টতা নেই। মাজার কমিটির লোকজন জানেন না এই নামে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে পবাখালী মাজারের সভাপতি নায়েব আলী বলেন, ‘আমাদের মাজারের নামে কোনো বরাদ্দ পাইনি। পবাখালী লালন একাডেমির নামে চাল তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে মনে করছি।’ কুঠিপাড়া জামে মসজিদের কোষাধ্যক্ষ ও মুয়াজ্জিন মো. আব্দুল আওয়াল বলেন, ‘আমার কাছ থেকে উপজেলার একজন ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে বলেছিল মসজিদের নামে অনুদান আসবে,তাই দিছিলাম। পরে একদিন গিয়ে আমার হাতে ৬ হাজার টাকা দিয়ে আসছে। কত কী বরাদ্দ আসছে,তার কিছুই জানি না। পরে ওই টাকা মসজিদের ফান্ডে জমা রেখেছি।’

এই রকমভাবে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে ভুয়া কমিটি তৈরি করে চাল বরাদ্দ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে প্রায় উপজেলাজুড়ে। এরমধ্যে পার্শ্বডাঙ্গা ইউনিয়নের মল্লিকপুর বড় জামে মসজিদ ও মল্লিকপুর পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদে ৪ মে.টর চাল বরাদ্দ পেয়ে তা উত্তোলন করেছেন শফিকুল ইসলাম। তিনি দুটি প্রকল্পেরই সভাপতি,হরিপুর ইউনিয়নের ধরইল জান্নাতুল বাকি কবরস্থান ও ধরইল জান্নাতুল বাকি কবরস্থান হাফিজিয়া মাদ্রাসা এতিমখানার সভাপতি হিসেবে ২ মে.টন চাউল ইত্তোলন করেছেন শফিকুল রহমান।এছাড়া মুলগ্রাম ইউনিয়নের বিভিন্ন মন্দির,শ্মশানঘাট,মহিলা মাদ্রাসা,ফোরকানিয়া মাদ্রাসা,এতিমখানা ও ঈদগাহ মাঠের নামে বরাদ্দকৃত চাল তুলে আত্মসাত করা হয়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে নিজেরা কমিটি তৈরি করে চাল উত্তোলন করেছেন। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানের আসল কমিটির লোকজন জানেনই না। কিছু প্রতিষ্ঠানের কমিটির লোকজনকে ম্যানেজ করতে কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই চাল উত্তোলন,বিক্রি ও টাকা আত্মসাতের বিষয়টি এখন “টক অব দা চাটমোহর”। এসকল প্রকল্পের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। 

এ বিষয়ে একাধিক অভিযুক্ত বলেন,‘যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখন কী করব বলেন,যারা ওটা করেছে তারা তো করেই ফেলছে। ওসব তো বলে তো আর লাভ নেই।

এ বিষয়ে চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মূসা নাসের চৌধুরী বলেন,‘ফৈলজানা ইউনিয়নের চাল বরাদ্দের অনিয়মের বিষয়ে একটি অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগের বিষয়ে আমরা ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্টদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দিয়েছি। তাঁদের জবাব সন্তোষজনক না হলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে