একটি সমাজের পতন অনেক সময় বোমা কিংবা গুলির শব্দে নয়, ঘটে নিঃশব্দে। আমাদের সময়ের সেই নিঃশব্দ ঘাতক হলো মাদক। শহর থেকে গ্রাম, সীমান্ত থেকে রাজধানীÑবাংলাদেশ আজ মাদকের ছায়া সাম্রাজ্যে আবদ্ধ। কখনো তা চলে রাজনীতির ছত্রছায়ায়, কখনো আইন প্রয়োগকারীর ছদ্মবেশে, আবার কখনো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ব্যবহারে। সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরাখবর থেকে জানা গেছে, ‘ভিন্ন পেশার মোড়কে মাদক ব্যবসা’ এবং ‘অভিযানেও থেমে নেই আগ্রাসন, বদলে গেছে সিন্ডিকেট’Ñবাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতির এক ভয়াবহ রূপ উন্মোচন করেছে। এই পরিস্থিতি শুধু অপরাধের সংকেত নয়, এটি আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার এক নগ্ন উদ্ঘাটন। সরকারি ভাষণে ও প্রচারপত্রে মাদকবিরোধী অভিযানের কথা বারবার উচ্চারিত হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলোÑএই অভিযানে কতটুকু কার্যকর পরিবর্তন এসেছে? অভিযানে ধরা পড়া ব্যক্তিরা বেশিরভাগই ‘চুনোপুঁটি’, রাঘব বোয়ালরা রয়ে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি বা উপকূলীয় এলাকার সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ উঠে, তখন আইনের শাসন মুখ থুবড়ে পড়ে। আজ দেশের সীমান্ত অঞ্চল থেকে রাজধানী পর্যন্ত যে মাদক জালের বিস্তার ঘটেছে, তা একটি ‘ছায়া অর্থনীতি’ গড়ে তুলেছে। ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা বা আইসÑএসব শুধু মাদক নয়, বরং একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ সংগঠিত বাণিজ্য। এতে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থী, কিশোর গ্যাং, এমনকি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি অংশÑযা আমাদের সামাজিক নিরাপত্তাকে আরও দুর্বল করে তুলছে। মাদকবিরোধী যুদ্ধ কোনো দিনই সফল হবে না, যদি না এর শিকড়Ñঅর্থাৎ রাজনৈতিক যোগসূত্র, প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং আইন প্রয়োগে পক্ষপাতিত্বÑউৎখাত করা যায়। মাদকের উৎস বন্ধ না করে কেবল বাহককে শাস্তি দিলে সমাজের দূষণ দূর হয় না। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রকে নীতি ও আইনের কঠোর প্রয়োগÑসবার জন্য এক নিয়ম, কোনো প্রভাবশালী ব্যতিক্রম নয়; সামাজিক সচেতনতাÑশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পরিবার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে গণমাধ্যমÑসব জায়গায় মাদকের বিরুদ্ধে অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে; পুনর্বাসন ও বিকল্প পথÑমাদকাসক্তদের জন্য চিকিৎসা, কাউন্সেলিং ও পুনর্বাসন, আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিকল্প জীবিকার সুযোগ তৈরি। এটা মনে রাখা জরুরি যে, মাদকবিরোধী যুদ্ধ কেবল রাষ্ট্রীয় নয়, এটি একটি সামষ্টিক সামাজিক লড়াই। প্রহরী যখন চোরে পরিণত হয়, তখন বিপদের মুখে পড়ে গোটা সমাজ। আমরা যদি আগামী প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে চাই, তবে এখনই আমাদের সংগ্রামকে দৃঢ়, সুসংগঠিত ও আন্তরিক করতে হবে। অভিযান চলুক, তবে সেটি যেন শুধু শিরোনাম না হয়, বরং হয় বাস্তবতা বদলের হাতিয়ার।