চট্টগ্রামের নাগরিক জীবনের একটি নির্মম ও অব্যবস্থাপনার প্রতীক হয়ে উঠেছে উন্মুক্ত খাল-নালার মৃত্যুফাঁদ। ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আগ্রাবাদের নালায় পড়ে প্রাণ হারানো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সেহেরীন মাহবুব সাদি ছিলেন এই মৃত্যুযাত্রার প্রথম সংবাদ শিরোনাম। সেই ঘটনার পর নগর কর্তৃপক্ষের অনেক আশ্বাস, সংবাদ সম্মেলনে প্রতিশ্রুতি, অস্থায়ী বাঁশের ঘেরাওÑসবকিছুর পরও বাস্তবতায় কিছুই পাল্টায়নি। চার বছরের ব্যবধানে অন্তত ১৪ জন মানুষ খাল-নালায় পড়ে মারা গেছেন, নিখোঁজ হয়েছেন আরও অনেকে। সর্বশেষ উদাহরণ ছয় মাস বয়সী শিশু সেহরিশের করুণ মৃত্যু। কাপাসগোলা এলাকার হিজড়া খালে পড়ে যাওয়া ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে শিশুটিকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ১৩ ঘণ্টা পর তার লাশ উদ্ধার হয় ২ কিলোমিটার দূরে। অথচ এই শিশুটির কোনো দোষ ছিল নাÑসেই দায় নিতে হবে সিটি করপোরেশনসহ নগরের দায়িত্বরত সংস্থাগুলোকে। দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রতিটি দুর্ঘটনার পর নাগরিক হতাশা আরও ঘনীভূত হয়, কিন্তু প্রশাসনের উদাসীনতা থেকে যায় একই রকম। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, নগরে ১১৩৭ কিলোমিটার খাল-নালা রয়েছে, যার মধ্যে বিপুল অংশই এখনো উন্মুক্ত। যেখানে প্রতিনিয়ত মানুষ চলাফেরা করে, সেখানে কোনো ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকা শুধু দায়িত্বহীনতা নয়, বরং এটি এক ধরনের অবহেলাজনিত হত্যা বলেও অভিহিত করা যায়। নগর পরিকল্পনাবিদরা বারবার বলে আসছেনÑঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো বর্ষার আগেই চিহ্নিত করে সেখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। জনগণকে সচেতন করতে হবে, কারণ নাগরিকরা কর দেন এবং এর বিনিময়ে সেবা পাওয়াটা তাদের অধিকার। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বর্ষা আসে, প্রাণহানি ঘটে, সংবাদ হয়, দায়সারা পদক্ষেপ নেওয়া হয়Ñতারপর সব কিছু আবারো শীতনিদ্রায় চলে যায়। চট্টগ্রামের খাল-নালা উন্নয়নে বহু কোটি টাকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের নামে বছরের পর বছর ধরে খাল সংস্কার চললেও ২১টি খাল এখনো বেহাল অবস্থায় পড়ে আছে। বড় বড় প্রকল্পের নামে যদি শহরের সাধারণ মানুষের জীবনরক্ষার ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা যায়, তাহলে সে উন্নয়নের উদ্দেশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এখন প্রশ্নÑআর কত মৃত্যু হলে কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে? শিশুর লাশ দেখেও যদি তারা জাগ্রত না হন, তাহলে ভবিষ্যতের আশাও মলিন হয়ে পড়ে। আমরা মনে করি, জরুরি ভিত্তিতে সিটি করপোরেশন, সিডিএ, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ প্রশাসনকে নিয়ে একটি সমন্বিত টাস্কফোর্স গঠন করে খাল-নালার ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করতে হবে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদি প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপও নিতে হবে। সবার আগে দরকার, নাগরিক জীবনের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। অবহেলিত এই প্রাণহানির প্রতিটি ঘটনার দায় যেন দায়হীনতার অজুহাতে হারিয়ে না যায়Ñএটা নিশ্চিত করা এখনই সময়।