ফেনীতে সুপেয় পানি ও সেচসংকট: জনজীবন ও কৃষির সামনে গভীর সংকেত

এফএনএস | প্রকাশ: ৭ মে, ২০২৫, ০৭:২৯ পিএম
ফেনীতে সুপেয় পানি ও সেচসংকট: জনজীবন ও কৃষির সামনে গভীর সংকেত

ফেনী জেলার মানুষের জীবনযাত্রা ও কৃষিকাজ বর্তমানে যে চরম সংকটে পড়েছে, তা নিছক কোনো মৌসুমি সমস্যা নয়-বরং এটি দেশের সামগ্রিক পানি ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট ও সতর্কতামূলক প্রতিচ্ছবি। সুপেয় পানির তীব্র সংকটের পাশাপাশি কৃষিজমির সেচ ব্যবস্থায়ও ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে স্থাপিত দুই লক্ষাধিক নলকূপের অধিকাংশই বর্তমানে অকার্যকর। ফলস্বরূপ, একদিকে মানুষ তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পানির জন্য হাহাকার করছে, অন্যদিকে কৃষকরা ফসল বাঁচাতে হিমশিম খাচ্ছেন। জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সরকারি নলকূপের সংখ্যা প্রায় ৩৭ হাজার হলেও এর এক-চতুর্থাংশ দীর্ঘদিন ধরে অকেজো। চালু থাকা নলকূপগুলোরও অর্ধেকের বেশি থেকে বর্তমানে পানি ওঠছে না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বসানো অগভীর নলকূপগুলোর অবস্থাও একইরকম। গ্রামের পর গ্রাম, ইউনিয়নের পর ইউনিয়নে এই সংকট দিনদিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে। অনেকে বাধ্য হয়ে শুকিয়ে যাওয়া নদী কিংবা দূরবর্তী জলাশয় থেকে পানি সংগ্রহ করছেন। নারীরা অজুর পানির জন্যও লাইন ধরছেন; রান্নার পানির জোগান দিতে গিয়ে দিনের বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে। এটি শুধু দৈনন্দিন জীবনের দুর্ভোগ নয়-এ এক প্রাত্যহিক লড়াই। কৃষিজমিতে এই সংকটের প্রভাব আরও বিপর্যয়কর। কৃষকরা ধান চাষ করেছেন, কিন্তু প্রয়োজনীয় সেচ পাচ্ছেন না। পুকুর, খাল, বিল সব শুকিয়ে গেছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অতিমাত্রায় নিচে নেমে যাওয়ায় গভীর ও অগভীর নলকূপ থেকে সেচ কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ধানের থোড় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ফসল ঘরে তোলা নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। এতে কৃষক শুধু ক্ষতির মুখে পড়ছেন না, বরং সামগ্রিকভাবে খাদ্য নিরাপত্তাও ঝুঁকির মুখে। এই সংকটের মূলে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন এবং পানি সংরক্ষণে দীর্ঘদিনের অবহেলা। দীর্ঘ শুষ্ক মৌসুম এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নামিয়ে দিয়েছে। প্রতি বছর পানির উৎসগুলো নীরবে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, অথচ তা রোধে নেই কোনো কার্যকর ব্যবস্থা। জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী যথার্থই বলেছেন-ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহারে গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু এই বাস্তবতা শুধু কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। এখন জরুরি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়নের। শহর ও গ্রামে পানির বিকল্প উৎস সৃষ্টি, খাল-বিল-পুকুর সংস্কার, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ এবং কৃষিখাতে পানির সাশ্রয়ী প্রযুক্তির ব্যবহার চালু করা ছাড়া এ সংকট কাটানো সম্ভব নয়। ফেনীর এই চিত্র আমাদের দেশের ভবিষ্যতের সংকটের আভাস দিচ্ছে। আজ যদি কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে আগামীতে আরও অনেক জেলা একই পরিণতির শিকার হবে। তাই এই মুহূর্তে জরুরি একটি সমন্বিত, দীর্ঘমেয়াদি পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা এবং জলবায়ু অভিযোজনকেন্দ্রিক উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ।