বাংলাদেশের নগর ও মহানগরগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ভয়াবহ দুরবস্থার চিত্র ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, গাজীপুর, কক্সবাজার, কুমিল্লা, ফেনীসহ দেশের প্রায় প্রতিটি শহর এখন যেন একেকটি খোলা ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, দুর্গন্ধ, ধুলাবালি ও বিষাক্ত বর্জ্যরে অনিয়ন্ত্রিত নিষ্কাশন এক চরম বিপর্যয়ের বার্তা দিচ্ছে। এটা কোনো নতুন সমস্যা নয়, তবে এটি যে এখন জাতীয় সংকটে রূপ নিয়েছে, তা আর অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রতিদিন বাড়ছে বর্জ্যরে পরিমাণ, কিন্তু সেই অনুপাতে গড়ে উঠছে না আধুনিক বা বিজ্ঞানভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। বরং দৃশ্যমান হচ্ছে পরিকল্পনার অভাব, দুর্বল মনিটরিং, এবং দায় এড়িয়ে চলার সংস্কৃতি। ঢাকায় খোলা জায়গায় ময়লা ফেলা, পোড়ানো, এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ পরিবেশকে বিষিয়ে তুলছে। উন্নয়নকাজে খোঁড়াখুঁড়ি ও ধুলাবালি পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (আইকিউ এয়ার)-এর তথ্যে দেখা যায়, বছরজুড়ে ঢাকার বায়ুমান থাকে ‘অস্বাস্থ্যকর’ থেকে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ স্তরে। এসবের অন্যতম কারণই হলো বর্জ্য পোড়ানো এবং অপরিকল্পিতভাবে ফেলা বর্জ্য। শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, গাজীপুর এমনকি পর্যটননগরী কক্সবাজার পর্যন্ত-সবখানে একই চিত্র। প্রতিটি শহরে বর্জ্য সংগ্রহ ও অপসারণ ব্যবস্থার দুর্বলতা চরম ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন মহাসড়কের পাশে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে, এমনকি আবাসিক এলাকায়ও ময়লার স্তূপ পড়ে থাকে দিনের পর দিন। ফলে দুর্গন্ধ, মশার উপদ্রব, পানি ও বায়ু দূষণ, এবং নানা রোগব্যাধির বিস্তার ঘটছে। হাসপাতাল, কসাইখানা বা কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যগুলো যথাযথভাবে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় জনস্বাস্থ্য পড়ছে মারাত্মক ঝুঁকিতে। এ পরিস্থিতির জন্য একদিকে যেমন স্থানীয় প্রশাসনের পরিকল্পনা ও সক্ষমতার ঘাটতি দায়ী, অন্যদিকে নাগরিক সচেতনতার অভাবকেও অস্বীকার করা যায় না। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, সঠিক বাজেট বরাদ্দের ঘাটতি, এবং আধুনিক প্রযুক্তি না থাকা সমস্যাকে আরও গভীরতর করেছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে একটি জাতীয় নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে, যেখানে নগর পরিকল্পনার সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টি সমন্বিত থাকবে। প্রতিটি নগর ও পৌরসভায় নির্দিষ্ট ডাম্পিং স্টেশন, আধুনিক বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র এবং আবর্জনা সংগ্রহের নির্ধারিত সময় ও রুট নির্ধারণ করে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নিতে হবে। একইসঙ্গে নাগরিকদের সচেতন করতে স্কুল, কলেজ, গণমাধ্যম ও সামাজিক প্ল্যাটফর্মে নিয়মিত প্রচার চালানো দরকার। জনসংখ্যা ঘনত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ, প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ এবং প্রযুক্তিনির্ভর পরিকল্পনার বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। নগরের উন্নয়ন যদি পরিবেশকে ধ্বংস করে, তবে তা উন্নয়ন নয়, আত্মঘাতী আগ্রাসন। পরিবেশ রক্ষা এবং জনস্বাস্থ্য নিরাপদ রাখার স্বার্থে অবিলম্বে কার্যকর, টেকসই এবং সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে-এটাই সময়ের দাবি।