নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ডাক্তার সেলিনা হায়াৎ আইভীকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে আরো একটা টুইস্ট এনেছে ছাত্রদের সরকার বা অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার। অভিযোগ আছে- বিভিন্ন দেশে পলাতক ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ ও দেশের ভেতরে আত্মগোপনে থাকা দলটির নেতাকর্মীদের সংগঠিত করার গোপন মিশন বাস্তবায়ন করছিলেন তিনি। রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করতে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে আন্দোলন চাঙ্গা করাসহ সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। অনেকে বলছেন- ডাক্তার সেলিনা হায়াৎ আইভী বেশ কিছুদিন ধরে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলেন। সংগঠিত করার চেষ্টা করছিলেন আওয়ামী লীগকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই আইভীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বেশ কিছু দিন ধরেই সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী নিজ বাড়িতে বসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম অ্যাপস ব্যবহার করে শেখ হাসিনাসহ বিদেশে পাড়ি জমানো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলেন। পাশাপাশি দেশের ভেতরে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীদের সঙ্গেও তিনি কথা চালিয়ে আসছিলেন। চেষ্টা করছিলেন সংগঠিত করার।
এমন নির্মম বাস্তবতার রাজনৈতিক বর্তমানে আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আইভী বেশ কিছু টেলিগ্রাম মিটিংয়ে যুক্ত হয়ে বক্তব্যও রেখেছেন বলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রমাণ দিচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে- মেয়র আইভী বাসায় বসে তার দলের লোকজনকে সংগঠিত করছিলেন তা প্রমাণিত। পুলিশ আইভীর বাসায় যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে তার বাসার সামনে শত শত মানুষ জড়ো হয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিয়েছে। এতেই বোঝা যায়, আইভী দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে ষড়যন্ত্র করছিলেন। তবে তাকে হত্যা মামলার আসামি হিসেবেই গ্রেফতার করা হয়েছে। জুলাই আন্দোলনের সময় হাসিনার গদি রক্ষার চেষ্টা করছিলেন আইভীও। এ কারণে ৫ আগস্ট ও এর আগে পরে শেখ হাসিনাসহ দলের নেতারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। যারা দেশ ছেড়ে পালাতে পারেননি তারা চলে যায় আত্মগোপনে। তবে আইভী নিজ বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। ক্লিন ইমেজের নেত্রী ধারণায় তিনি এতদিন ছিলেন গ্রেফতারের বাইরে। তবে আড়ালে তিনি দেশবিরোধী তৎপরতায় যুক্ত ছিলেন তা ছিল অবিশ্বাস্য।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, হত্যা মামলা মাথায় নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ রাতের আঁধারে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণে সরকার বেশ সমালোচনায় পড়ে। সেই আলোচনা সমালোচনা থেকে দৃষ্টি ফেরাতে রাতভর নানা নাটকীয়তার পর আইভীকে গ্রেফতার করা হয়েছে কিনা সে প্রশ্নও রয়েছে কারও কারও মনে। তাকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হলেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রিমান্ডের আবেদন করেননি। তাকে গ্রেফতারের পর মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ তাকে আদালতে তোলে। পরে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। বর্তমানে তিনি কাশিমপুর মহিলা কারাগারে আছেন। পুরো বিষয়টি গভীর পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি- ‘খেলা হবে’ স্লোগানের খেলোয়াড় শামীম ওসমানের চিরশত্রু হিসেবে ব্যাপক পরিচিত সাবেক মেয়র আইভীকে গ্রেফতার করা প্রক্রিয়ায়ও ছিল পুলিশের ভিন্ন কৌশল। তবে তাকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে একথাও সত্য যে, রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ নামে রাজনীতিতে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের যে গুঞ্জন ডালাপালা ছড়িয়েছিল-আইভীর মাধ্যমে সে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছিল। আওয়ামী রাজনীতির অনন্য ব্যক্তিত্ব আলী আহমদ চুনকার সন্তান সাবেক মেয়র ডাক্তার সেলিনা হায়াৎ আইভী বরাবরের মত সাহসিকতার সাথে স্বাভাবিকভাবে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরও বেশ কিছু দিন সিটি করপোরেশনে অফিস করেছেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের সব সিটি করপোরেশনের মেয়রদের অব্যাহতি প্রদান করে। এরপর প্রায় ৯ মাস অতিবাহিত হলে ‘হামিদ এক্সিট’ বিষয়ে সরকার সমালোচিত হওয়ায় আইভীকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে ইস্যু পরিবর্তনের পথে এগিয়ে চলছে ছাত্রদের সরকার খ্যাত অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার।
যতদূর জেনেছি- সাবেক রাষ্ট্রপতিরা আমৃত্যু বিচারপতির পদমর্যাদা ভোগ করে থাকেন। এছাড়া বিদ্যমান আইনেও সাবেক রাষ্ট্রপতিদের ব্যবহৃত পাসপোর্ট সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা নেই। তবে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের অন্যতম দোসর হিসেবে সরকার চাইলে আবদুল হামিদের পাসপোর্ট বাতিলে বিশেষ নির্দেশনা দিতে পারত। তা না করে ‘হামিদ এক্সিট’ সুব্যবস্থায় প্রচুর অর্থ লেনদেন হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। সেই ধারাবাহিকতাতেই সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ দেশ ছাড়েন কূটনৈতিক সুবিধার বিশেষ পাসপোর্টে (নম্বর ডি০০০১০০১৫)। রাষ্ট্রপতি থাকার সময় ২০২০ সালের ২১ জানুয়ারি তার নামে ১০ বছর মেয়াদি এই পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়। ২০৩০ সালের পহেলা জানুয়ারি পর্যন্ত এর মেয়াদ রয়েছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের লাল পাসপোর্ট ইতোমধ্যে বাতিল হলেও আবদুল হামিদের পাসপোর্ট বাতিল হয়নি। যা নিয়ে এখন নানারকম প্রশ্ন ডালপালা মেলছে যখন, তখনই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলন হলো যমুনার পাশে মঞ্চ বানিয়ে, সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে, সরকারের বিভিন্ন সহায়তায়। সেই আন্দোলনের পথ ধরে সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলো জুলাই আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন প্রথম কার্যদিবসে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুসারে-আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনে দলটির বিচার হবে। এই বিচারের পূর্ব পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে। বৈঠক শেষে যমুনার সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। ব্রিফিং শুরুর আগে আসিফ নজরুল কানে-মুখে কথা বলে একজনকে দিয়ে ঘোষণা করান ‘কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।’ পরবর্তীতে তিনি আবার বলেন- ‘এক কথা দুবার বলবো না’ এরপর তিনি বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় তিনটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদন হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী এই ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, দলের অঙ্গসংগঠন, সমর্থক সংগঠন বা তার নেতাকর্মীকে শাস্তি দিতে পারবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচার কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরিপত্র পরবর্তী কর্মদিবসে জারি করা হবে। পাশাপাশি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জুলাই ঘোষণাপত্র আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত করে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নেটিজেনরা অবশ্য পুরো ঘটনাটিকে সাজানো বললেও এই সিদ্ধান্তের পরপরই রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে অবস্থান নেওয়া আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলনকারীরা আনন্দ মিছিল বের করেন। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা আনন্দ-উল্লাস করে বিভিন্ন স্লোগান দেন। পুরো ঘটনাটির পোস্টমর্টেম করলে দেখা যায়- গত ৭ মে রাত ১০টার পর এই আন্দোলনের সূচনা হয়। এর কারণ ছিল সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের দেশত্যাগ। ওই দিন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)’র ডাকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে জড়ো হতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পালটে যায় দৃশ্যপট। মাঠে নামে শাপলা চত্বর ও পিলখানা হত্যাকাণ্ডের শিকার পরিবারের সদস্যসহ আহত জুলাই যোদ্ধারাও। বৃহস্পতিবার রাতভর বিক্ষোভ চলার পর শুক্রবার বাদ জুমা যমুনার পাশে ফোয়ারার সামনে বড় জমায়েত হয়। ডাক আসে শাহবাগ ব্লকেডের। এদিন রাজধানীর উত্তরাসহ ঢাকার কিছু প্রবেশমুখে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। বিভাগীয় শহর কিংবা জেলা-উপজেলায়ও ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে তারাও সমানতালে নামেন সড়কে। সিদ্ধান্ত না এলে এরই মধ্যে ফের ‘মার্চ টু ঢাকা’র হুঁশিয়ারি দিয়েছিলো নেতারা। একই সঙ্গে তিন দফা দাবিতে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছে জানিয়ে শুক্রবার বিবৃতি দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, ‘রাজনৈতিক সব দলের সঙ্গে এরই মধ্যে যোগাযোগ করেছে সরকার। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতা-সমর্থকদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন সরকার বিবেচনায় রাখছে।’ তবে পুরোপুরি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত ময়দান না ছাড়ার ঘোষণা দেন বিক্ষোভকারীরা। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০০৯ সাল থেকে ১৬ বছরের শাসনামলে অনিয়ম-গণহত্যা, গুম-খুন, নির্যাতন, অর্থ বাণিজ্যসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধ করেছে আওয়ামী লীগ। দলটির সভাপতি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়েছে এ রিপোর্টে। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে তিনটি জাতীয় নির্বাচন জালিয়াতি করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল টিকিয়ে রাখা হয়েছিলো। তারা জামায়াতে ইসলামকে নিষিদ্ধও করেছিলো। আজ জামায়াত-শিবির-এনসিপিসহ তাদের সহমতের রাজনৈতিক দলগুলো আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেছে ইতিহাস থেকে অতীত থেকে না শিখে। আজ যেই সিদ্ধান্ত অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার নিয়েছে, সেই একই সিদ্ধান্ত যদি ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দল ও সরকার নেয়, তখন একটুও অবাক হবো না। কারণ এই দেশ-এই দেশের মানুষ শেখে না। কেবল লোভ-মোহের ঘোড়ায় চড়ে চলতে থাকে আর বলতে থাকে ‘আমাদের সাথে জনগণ আছে...’ কিন্তু জনগণ বলতে কি শাহবাগ চত্বরে বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাড়ি ভাড়া করে আনা কয়েক লাখ মানুষকেই বোঝায় নাকি প্রায় ২০ কোটি মানুষকে বোঝায়...
লেখক: মোমিন মেহেদী; ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক পূর্বাভাস