জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনাগুলোকে ঘিরে “গণহত্যা” ও “জেনোসাইড” শব্দ ব্যবহারে বিভ্রান্তি দেখা দেওয়ায় বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। গণমাধ্যমে তার বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে দাবি করে মঙ্গলবার (১৩ মে) চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ ও বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। একই দিনে তাজুল ইসলাম নিজের ফেসবুক পোস্টেও বিষয়টি পরিষ্কার করে মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, “ম্যাস মার্ডার (Mass Murder) অর্থ গণহত্যা। জেনোসাইড (Genocide) অর্থ জাতিগত নির্মূল বা এথনিক ক্লিনজিং। আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী, জুলাইয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তবে তা জেনোসাইডের আওতায় পড়ে না।”
সম্প্রতি কিছু গণমাধ্যমে চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের একটি খণ্ডাংশ উদ্ধৃত করে বলা হয় যে, জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে “গণহত্যা হয়নি”। এই বক্তব্যকে বিকৃত এবং প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষাপট ছাড়া উপস্থাপনা হিসেবে অভিহিত করে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “চিফ প্রসিকিউটর স্পষ্টভাবেই বলেছেন, দেশে পদ্ধতিগতভাবে ব্যাপক মানুষ হত্যা (ম্যাস মার্ডার) সংঘটিত হয়েছে। তবে তা জেনোসাইড নয়।”
বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, “চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটি আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে যথার্থ এবং সুসংহত। কিন্তু গণমাধ্যমের কিছু সংবাদে তা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।”
গত ১২ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
চিফ প্রসিকিউটর জানান, তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র (Formal Charge) আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে। প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগের কথা বলা হয়, যার মধ্যে দুটি হলো—উসকানি দেওয়া ও হত্যাকাণ্ডে নির্দেশনা প্রদান। তার বেশ কিছু ফোনালাপের রেকর্ডও এসব অভিযোগের অন্তর্ভুক্ত বলে জানানো হয়।
চিফ প্রসিকিউটরের ব্যাখ্যায় উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী “গণহত্যা” (Mass Murder) এবং “জেনোসাইড” (Genocide)-এর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য। গণহত্যা বলতে বুঝানো হয় নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রেক্ষাপটে বড় আকারের মানুষ হত্যাকে। কিন্তু জেনোসাইড হলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম বা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস।
তাজুল ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশে যা ঘটেছে, তা ছিল একটি সুপরিকল্পিত, পদ্ধতিগত গণহত্যা, যা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত। তবে এটিকে জেনোসাইড বলা যায় না, কারণ এতে জাতিগত নির্মূলের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।”
আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে এই অপরাধে জড়িত কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে চিফ প্রসিকিউটর জানান, বিষয়টি এখনো বিবেচনাধীন। সংশ্লিষ্ট আইনে সম্প্রতি একটি সংশোধনী আনা হয়েছে। তদন্ত সংস্থা চাইলে দলীয়ভাবে জড়িত থাকার বিষয়েও তদন্তের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বলে জানান তিনি।