ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার নিখোঁজের ১ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। এমপি আনারকে হত্যা করা হয়েছে কি না এ নিয়ে নানা প্রশ্ন আর ধোয়াশা রয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। ইনডিয়ার মাটিতে বাংলাদেশের একজন এমপি খুনের সিকার হলেও এক বছরে তার দেহাবশেষ বা আলামত পায়নি পরিবার। ২০২৪ সালের ১২ মে দর্শনার গেদে বর্ডার দিয়ে ইনডিয়া যান এমপি আনার। আনার ছিলেন ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ ও সদরের আংশিক) আসন থেকে পতিত ফ্যাসিষ্ট আওয়ামীলীগ সরকারের দলীয় সংসদ সদস্য।২০২৪ সালের একতরফা ভোটে তৃত্বীয়বারের মত নির্বাচিত হওয়ার ৫ মাসের মাথায় ভারতে গিয়ে নিখোঁজ হন তিনি। নিখোঁজের ১০ দিন পর ২২ মে সকালে কলকাতার নিউটাউন এলাকার সঞ্জিভা গার্ডেন থেকে আনারের মরদেহ উদ্ধার করা হয় বলে সেদেশের গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করে। এরপর থেকে একের পর নাটকিয়তার মধ্যে দিয়ে এক বছর পূর্ণ হলেও এমপি খুনের ঘটনা নিয়ে পারিবার ও দেশের মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া ধোয়াশা কাটেনি।পরিবারের দাবি খুন হয়ে থাকলে এমপি আনারের মরদেহ বা দেহাবশেষ দেওয়া হোক। যা কবরস্থ করে স্বস্তি পেতে চাই তার পরিবার। সাথে সাথে আনার হত্যা হয়ে থাকলে এর সাথে জড়িতদের বিচার চান। এদিকে ইনডিয়া পুলিশের দাবি খুন হওয়া ওই হোটেলের সেপটিক ট্যাং থেকে আনারের দেহাবশেষ উদ্ধার করেছে। যদিও তার কোন আলামত বা দেহাবশেষ এখনো পর্যন্ত তার পরিবার পায়নি।
এমপি আনারের ভাই এনামুল হক ইমান বলেন, এক বছর পার হলেও আমার ভায়ের সঠিক তথ্য আমরা পায়নি। যদি আমার ভাই খুন হয়েই থাকে তাহলে তার দেহাবশেষ আমাদের দেওয়া হোক। আমরা আমার ভাইকে কবরস্থ করে একটু স্বস্তি পেতে চাই। আমার ভাই হাজার হাজার মানুষের জানাজায় অংশ নিয়েছে কিন্তু আমার ভাইকে আমার জানাজা করতে পারলাম না। আমার ভায়ের শেষ স্মৃতি কবর তৈরি করতে পারিনি।
২০২৪ সালের ১২ মে রোববার দুপুরে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার চিকিৎসার জন্য দর্শনার গেদে বন্দর দিয়ে ভারতের কলকাতায় যান। সেখানে পৌছে পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার অন্তর্গত মন্ডলপাড়া লেনে গোপাল বিশ্বাস নামে পরিচিত এক বন্ধুর বাড়িতে ওঠেন। পরের দিন ১৩ মে ডাক্তার দেখানোর জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। এরপর থেকে রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হয়ে যান আনোয়ারুল আজিম আনার। এরপর থেকে পরিবার ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাকে ফোনে বা কোনো মাধ্যমে না পেয়ে বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে জানান উদ্বিগ্ন এমপি পরিবার। এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে ১৮ মে থানায় একটি মিসিং ডাইরি করেন এমপি’র পরিচিত ভারতের বরাহনগরের বাসিন্দা গোপাল বিশ্বাস। এদিকে বাবার খোঁজে এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন রাজধানীর মিন্টো রোডে অবস্থিত মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে যান। সেখানে তিনি বাবার মিসিং ডায়েরী করেন।
এ ঘটনায় ৯ জন গ্রেফতার হলেও হোতা শাহীন এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। হত্যার পর যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়েছে বলে ধারণা পুলিশের।তদন্তে নেমে যশোর অঞ্চলের চরমপন্থি নেতা আমানুল্লাহ ও তার ভাতিজা তানভীর এবং খুনের মূল পরিকল্পনাকারী যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শাহিনের বান্ধবী সেলেস্তিকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। ধরা পড়ে ঝিনাইদহের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিন্টু ও আরেক নেতা বাবু। খাগড়াছড়ির পাহাড় থেকে ধরা পড়ে দুই ভাড়াটে খুনি ফয়সাল ও মোস্তাফিজ। ভারত ও নেপালে গ্রেফতার হয় জিহাদ ও সিয়াম। পুলিশ জানায়, স্বর্ণ চোরাচালাল নিয়ে শাহীনের সঙ্গে দ্বন্দের জেরে খুন হন আনার।বাগজোলা খালে মেলে আনারের হাড়। সঞ্জিভা গার্ডেনের সেপটিক ট্যাংক মেলে প্রায় ৪ কেজি মাংস। উদ্ধার হওয়া দেহাংশের সঙ্গে মিলে যায় আনারের মেয়ের ডিএনএ। হত্যার ৮৭ দিনেই মামলার অভিযোগপত্র দেয় পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি।৫ আগস্টের পর এ মামলা নিয়ে দুদেশের তদন্ত সংস্থার তৎপরতা ঝিমিয়ে পড়েছে। ডিএনএ রিপোর্ট দেশে এনে অপহরণ মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরের উদ্যোগ নেয়নি বাংলাদেশের পুলিশ। গ্রেফতার ৭ আসামির ৬ জন আদালতে জবানবন্দি দিলেও ৯ বার পিছিয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন জমার তারিখ।আটককৃতদের স্বীকারুক্তি অনুযায়ি আনার খুন হয়েছে নিশ্চিত হয়ে ইনডিয়া পুলিশ ২২ মে থেকে উদ্ধার অভিযান শুরু করে। এদিকে আনারের পরিহিত পোশাক বা শরীরের কোন অংশ উদ্ধার না হওয়ায় আনুষ্ঠানিক দাফন বা জানাযার দোয়া অনুষ্ঠান করতে পারেনি পরিবার ও তার কর্মী-সমর্থকরা। এছাড়া মরদেহ উদ্ধার না হওয়ায় সরকার পতনের আগ পর্যন্ত আওয়ামীলীগ থেকেও কোন কর্মসূচী গ্রহন করেনি। গেল এক বছরে আনার খুনের ঘটনায় দুই দেশে ৭ জনকে আটক করেছে দু’দেশের পুলিশ। এরমধ্যে বাংলাদেশে ৪ ও ভারতে ৩ জন আটক হয়েছে। এরমধ্যে ২০২৪ সালের ১১ জুন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্ট ও ৮ জুন জেলা আওয়ামীলীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু রয়েছে। আনার খুনের সাথে জড়িত অভিযোগে আটক ওই দুই আ’লীগ নেতা বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। ২২ মে আনার হত্যার সংবাদ প্রকাশ্যে আসার পর এমপির পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে আসেন আনার খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু ও ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ ওরফে গ্যাস বাবু।এদিকে ঘটনার প্রায় এক মাস পর হত্যার আলামত ও মোবাইল উদ্ধারে আসেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশিদ। ডিবি প্রধান হারুন একটি বিশেষ হ্যলিকপ্টারে করে ঝিনাইদহ বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্টেডিয়ামে নামেন। দু’টি পুকুরে জেলে নামিয়ে আলমত উদ্ধারের নামে নাটক করে চলে যান বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এদিকে আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার ঘটনায় কসাই জিহাদ হাওলাদার এবং সিয়াম হোসেনকে আসামি করে পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত আদলাতে চার্জশিট দেয় সে দেশের পুলিশ। তবে হত্যাকাণ্ডের ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আখতারুজ্জামান শাহীনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলে আসল কারণ জানা যাবে বলে পুলিশ ওই চার্জশীটে উল্লেখ করে। যদিও হত্যাকাণ্ডের ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ আখতারুজ্জামান শাহীন রয়েছে ধোরাছোয়ার বাইরে।
আনোয়ারুল আজীম আনার ঝিনাইদহ-৪ আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য। তিনি ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে টানা ৩ বার আওয়াামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার রাজনৈতিক জীবনে আলোচিত বিষয় ছিল নির্বাচনী এলাকায় যে কোন ব্যক্তি মারা গেলে তার বাড়িতে গিয়ে শোকার্ত পরিবারকে শান্তনা দিতেন। এমনও হয়েছে তিনি একদিনে ১০ জন মৃত্যু ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সাথে দেখা করেছেন। এ পর্যন্ত তিনি ১০ সহাস্রাধিক মৃত্যু ব্যক্তির দোয়া অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। যা দেশের একজন জনপ্রতিনিধি হিসাবে বিরল। আনার ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি কালীগঞ্জ শহরের মধুগঞ্জ বাজার এলাকায় জন্মগ্রহন করেন। তার বাবার নাম ইয়াকুব আলী ও মাতার নাম জহুরা খাতুন। এমপি আনার জেলার কালীগঞ্জ শহরের ভূষণ রোড়স্থ বাড়িতে বসবাস করতেন। তার দুই মেয়ে ও স্ত্রী রয়েছে।
১৯৯৩ সালে কালীগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নির্বাচনে কমিশনার নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৪ সালে একই পৌরসভায় চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে পরাজিত হন। ২০০০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তার নামে ২১ মামলা হয়। ২০০৮ সালে অস্ত্র ও বিস্ফোরক মামলায় ইন্টারপোলের মোষ্ট ওয়ান্টেড তালিকায় তার নাম ওঠে। ২০০৯ সালে আনার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জয়লাভ করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামীলীগের দলীয় প্রতিক নৌকা নিয়ে নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৮ ২০২৪ সালে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন নিয়ে টানা তিনবার নির্বাচিত হন। শেষ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পাঁচ ম মাসের মাথায় ঘাতকের হাতে হত্যার স্বীকার হন পতিত আওয়ামীলীগের এ এমপি।