রাজধানী ঢাকায় বহুতল ভবনের রেস্টুরেন্টগুলো এখন যেন একেকটি চলমান ঝুঁকির কেন্দ্র। একের পর এক অগ্নিদুর্ঘটনা, প্রাণহানি ও আহতের ঘটনা ঘটলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিংবা রেস্টুরেন্ট মালিকপক্ষ- কারো মাঝেই দৃশ্যমান কোনো জবাবদিহি বা পরিবর্তনের ইঙ্গিত নেই। ভয়াবহতা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, এই অগ্নিকাণ্ডগুলো আজ ‘নিয়মিত ঘটনা’ বা ‘ডালভাত’ হিসেবেই গণ্য হচ্ছে। বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ রেস্টুরেন্টে ২০২৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ছিল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া এক বিপর্যয়। অথচ ১৪ মাস পর একই সড়কের আরেক ভবনে- ক্যাপিটাল সিরাজ সেন্টারে ফের আগুন লাগে। যদিও প্রাণহানি হয়নি, তবু ঘটনাটি ভবিষ্যতের আরো বড় বিপদের বার্তা দেয়। এর মধ্যেই উত্তরার লাভলীন রেস্টুরেন্টে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ড পরিস্থিতির গভীরতা ও ছড়িয়ে পড়ার মাত্রা বোঝায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ রেস্টুরেন্ট অতিঝুঁকিপূর্ণ এবং রাজধানীর প্রায় ৯৯ শতাংশ রেস্টুরেন্টেই নেই কার্যকর অগ্নি নিরাপত্তাব্যবস্থা। এক সিঁড়ি, সরু পথ, অপ্রতুল বা অনুপযুক্ত লিফট, বিকল্প বহির্গমন পথের অভাব এবং অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের সীমাবদ্ধতা- এসব রেস্টুরেন্টকে বাস্তবে মৃত্যু ফাঁদে পরিণত করেছে। এখানে প্রশ্ন ওঠে, এতবার দুর্ঘটনার পরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কেন কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি? উত্তরটি যতটা সহজ, বাস্তবতা ততটাই করুণ। ঢাকা মহানগরীতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা এখন একটি ‘ট্রেন্ড’ হয়ে দাঁড়ালেও এই খাতে নেই কোনো সমন্বিত নিরাপত্তা পরিকল্পনা। যেসব রেস্টুরেন্ট ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের শিকার হচ্ছে, সেগুলোর বেশির ভাগই তৈরি হয়েছে ২০০৮ সালের আগের নীতিমালার ভিত্তিতে। কিন্তু এতদিনেও সেগুলোকে বর্তমান নিরাপত্তা মানদণ্ডে উন্নীত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স-এর সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান যথার্থই বলেছেন, নিরাপদ রেস্টুরেন্ট ব্যবসার জন্য দরকার ‘মেগা ব্যবস্থাপনা’। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই সেবা খাতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো দুর্বল এবং অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতিগ্রস্ত। অবৈধ লেনদেন, ‘ম্যানেজমেন্ট’-নির্ভর ব্যবস্থা এবং দায়সারা মনোভাবের বলি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। প্রশাসনের উচিত, অতিঝুঁকিপূর্ণ রেস্টুরেন্টগুলো অবিলম্বে চিহ্নিত করে বন্ধ করে দেওয়া। মাঝারি ও অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোকে নির্ধারিত সময়সীমা ও পর্যাপ্ত পরামর্শ দিয়ে নিরাপদ কাঠামোতে রূপান্তরের সুযোগ দেওয়া। একইসঙ্গে, সেবা সংস্থাগুলোকে আইনি ও কাঠামোগত সংস্কারের আওতায় এনে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। যতদিন পর্যন্ত না এই সমস্যাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘গভীর সংকট’ হিসেবে দেখা হবে, এবং দায়িত্বশীলরা ‘দায়িত্বে’ ফিরবেন, ততদিন শহরজুড়ে নিরাপদ খাবার খাওয়ার আশ্বাস নয়, বরং আতঙ্কের সাথে বেঁচে থাকার লড়াই চলবে।