জাতীয় সংসদের এলডি হলে রোববার (১৮ মে) অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনসহ সমগ্র রাজনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়াকে আইনগত ভিত্তি দিতে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অংশ নিয়ে দলটি ‘জুলাই সনদ’সহ অন্যান্য বিষয়ে গণভোটের মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানায়।
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা চাই, জনগণের সরাসরি মতামতের ভিত্তিতে জাতীয় সিদ্ধান্ত হোক। যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে, কিংবা যেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও এখনও ঐকমত্য হয়নি—সেসব বিষয় গণভোটের মাধ্যমে আইনগত ভিত্তি পাক।”
তিনি আরও বলেন, “জুলাই সনদ হোক, জাতীয় সনদ হোক কিংবা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু—সবকিছুই আমরা গণভোটের আওতায় আনতে চাই। সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া প্রকৃত জাতীয় ঐকমত্য সম্ভব নয়।”
জামায়াতের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, তারা লোয়ার হাউজ ও আপার হাউজ—উভয় স্তরের নির্বাচনের জন্য পিআর (প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) পদ্ধতির পক্ষে।
সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দীর্ঘ বৈঠকে ১২০টিরও বেশি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছায় জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধি দল। একাধিক ক্ষেত্রে তারা দলীয় অবস্থান থেকে সরে এসে জাতীয় স্বার্থে সমঝোতা করেছে বলে জানান তাহের।
বিশেষভাবে আলোচিত কিছু প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে—
• প্রধান বিচারপতি নিয়োগ: জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে প্রস্তাবিত বিচারপতির বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে কোনো অভিযোগ না থাকা আবশ্যক বলে মত দেয় জামায়াত।
• দুর্নীতি দমন কমিশন: সংস্থাটি কখনো কখনো নিজেই দুর্নীতিগ্রস্ত হয় বলে মন্তব্য করে কমিশনের কার্যক্রম পর্যালোচনায় একটি টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে জামায়াত।
• ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ: দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদ পৃথক ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেয় জামায়াত। একই ব্যক্তি যেন দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন—এমন বিধান প্রস্তাব করেছে দলটি।
• প্রাদেশিক বিভাজন: বাংলাদেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জামায়াত। পরিবর্তে জনপ্রশাসনের জন্য একটি স্থায়ী কাউন্সিল গঠনের পরামর্শ দেয় তারা।
সংস্কার প্রক্রিয়ায় জামায়াত সবসময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে ছিল এবং এখনও সেই অবস্থানেই আছে বলে স্পষ্ট করেন তাহের। তাঁর মতে, একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা।
সংলাপের শুরুতেই জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, “সংস্কার ইস্যুকে আমরা শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, ধর্মীয় ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও বিবেচনা করছি। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে—দেশ ও জাতির কল্যাণ নিশ্চিত করা।”
তিনি সাম্প্রতিক দেশে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনাবলির সমালোচনা করে বলেন, “সরকার যেন এসব ঘটনায় কঠোর পদক্ষেপ নেয়, জামায়াত এতে সমর্থন জানাবে। আমরা চাই নির্বাচন হোক অবাধ, সুষ্ঠু ও সহিংসতামুক্ত।”
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আলোচনায় নেতৃত্ব দেন দলের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের। সঙ্গে ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম মাসুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, ডা. হামিদুর রহমান আযাদ, অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, সাইফুল আলম খান মিলন ও অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দসহ ১১ সদস্যের প্রতিনিধি দল।
অন্যদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, মো. আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।