রাজশাহীর তানোর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী তালন্দ ললিত মোহন ডিগ্রি কলেজের সভাপতি নিয়ে চরম অচলাবস্থা বিরাজ করছে। সভাপতি নিয়োগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হঠকারিতায় এ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে এ কলেজের দুজনকে সভাপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী এই কলেজে এক সময় দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতেন। শহরের অনেক কলেজে আবাসন না থাকলেও প্রত্যন্ত গ্রামে অবস্থিত এই কলেজটিতে তা রয়েছে।
শিক্ষার মানের কারণেই কলেজটি একসময় জেলার গন্ডি পেরিয়ে জাতীয়ভাবে শ্রেষ্ঠ কলেজেরও স্বীকৃতি পায়। পতিত আওয়ামী সরকারের সময়ে গভর্নিং বডির সভাপতির পদে থেকে শিক্ষক নিয়োগে বেপরোয়া বাণিজ্য করেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। গভর্নিং বডির পর্যবেক্ষণের অভাবে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমে যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কলেজটিতে আবারও গতি ফিরতে শুরু করেছিল। তবে সম্প্রতি কলেজের সভাপতি নিয়োগ নিয়ে নতুন করে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতবছর কলেজের এডহক কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয় কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও প্রতিষ্ঠাতা সেলিম উদ্দিন কবিরাজকে। তিনি অধ্যক্ষ থাকাকালীন অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষার মানও বাড়িয়েছিলেন। এজন্য তিনি জাতীয়ভাবে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে পুরস্কারও পান। তার অতীত অবদান বিবেচনায় স্থানীয়রা তাকেই এডহক কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে মনোনয়ন দেন।
পরবর্তীতে নিয়মিত গভর্নিং বডি গঠনের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ সভাপতি পদে তিনজনের নাম প্রস্তাব করে। গত ১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো এই তালিকায় ছিলেন সেলিম উদ্দিন কবিরাজ, আইনুল হক ও দেওয়ান মো. মকসেদুর রহমান। কিন্তু এই তিনজনকে উপেক্ষা করে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফনির উদ্দিন নামের একজনকে সভাপতি করে চিঠি পাঠানো হয়। এরপর থেকেই কলেজে সংকট শুরু হয়।
তালিকাভুক্ত নয়-এমন একজনকে সভাপতি করায় কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ড. মো. জসিম উদ্দীন মৃধা পরদিনই বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে আবেদন করেন। এই আবেদনপত্রে কলেজের ৬৩ জন শিক্ষক স্বাক্ষর করেন। এরপর গত ১১ মার্চ গভর্নিং বডির সভা ডাকেন সভাপতি ফনির উদ্দিন। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষের তালিকার বাইরে থাকা সভাপতি হওয়ায় সদস্যরা তার বিরুদ্ধে অনাস্থা জানান এবং কেউ সভায় যোগ দেননি। ১৫ মার্চ বিষয়টি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শককে চিঠি দিয়ে অবহিত করেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান।
এতে সুপারিশ করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু, সাবেক সিটি মেয়র মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল এবং জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদ।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এরপরও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং ফনির উদ্দিন গত ২৭ মার্চ ও ৩ এপ্রিল আরও দুটি সভা ডাকলেও গভর্নিং বডির কোনো সদস্য তাতে উপস্থিত হননি। ফলে ৯ এপ্রিল অধ্যক্ষ জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে আবেদন করেন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২৯ এপ্রিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সেলিম উদ্দিন কবিরাজকে সভাপতি হিসেবে মনোনয়ন দেয়। কিন্তু মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ৩০ এপ্রিল আবারও ফনির উদ্দিনকে সভাপতি করে চিঠি দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ এই চিঠি হাতে পায় ৪ মে।
এ নিয়ে ৬ মে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে চিঠি দিয়েছেন সাবেক সভাপতি সেলিম উদ্দিন কবিরাজ। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, ২৯ এপ্রিল তাকে সভাপতি করা হলে তিনি ৩ মে গভর্নিং বডির সভা ডাকেন এবং সব সদস্য তাতে অংশ নেন।
কিন্তু ৪ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি চিঠিতে তিনি দেখতে পান, ৩০ এপ্রিলের তারিখে ফনির উদ্দিনকে আবারও সভাপতি করা হয়েছে। এতে কলেজে আরও বড় সংকট সৃষ্টি হয়।
এ পরিস্থিতিতে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার খোন্দকার আজিম আহমেদ গত ১২ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। তাতে তিনি লিখেছেন, ‘২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ফনির উদ্দিনকে কলেজের সভাপতি করে।
কিন্তু তিনি কলেজ কর্তৃপক্ষের পাঠানো তিনজনের তালিকায় ছিলেন না। এরপর সদস্যদের অনাস্থার কারণে তালিকার ১ নম্বরে থাকা সেলিম উদ্দিন কবিরাজকে সভাপতি করা হয়। অথচ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আবারও ফনির উদ্দিনকে সভাপতি করা হয়েছে। এতে কলেজের পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে এবং শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।’ চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতির নিয়োগের ক্ষমতা থাকলেও পূর্বের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোনো কারণ জানানো হয়নি।
এত দ্রুত সভাপতি বদল করলে শিক্ষার পরিবেশ যেমন নষ্ট হয়, তেমনি প্রশাসনিক কার্যক্রমেও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
এ বিষয়ে কলেজের সাবেক সভাপতি সেলিম উদ্দিন কবিরাজ বলেন, আওয়ামী সরকারের সময়ে শিক্ষক নিয়োগসহ নানা অনিয়মে কলেজটাকে শেষ করে দেওয়া হয়েছিল। সরকার পতনের পর আমাকে আহ্বায়ক করা হলে আমরা কলেজটাকে আবারও গুছিয়ে তুলছিলাম।
কিন্তু এখন আমারই ছাত্র এবং কলেজের সাবেক শিক্ষক ফনির উদ্দিনকে সভাপতি বানানোর চেষ্টা চলছে। কয়েকজন ব্যক্তি কলেজে এমন অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছেন।
এ বিষয়ে কথা বলতে সভাপতি ফনির উদ্দীনকে ফোন করা হলে তিনি সভায় আছেন জানিয়ে কথা বলতে চাননি। পরে কয়েকদফা ফোন করা হলেও ধরেননি।
কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ড. জসিম উদ্দীন মৃধা বলেন, সভাপতির পদ নিয়ে জটিলতার ফলে কলেজে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। সভাপতি ফনির উদ্দীনের পরামর্শে পর পর তিনটি সভা ডেকেও কারো সাড়া মেলেনি।
ফলে কলেজে স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্ন হচ্ছে। এটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়, ওনারা কীভাবে সমাধান করবেন জানি না।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক ও সচিব আমিনুল আক্তার বলেন, রাজশাহীর তালন্দ কলেজ নিয়ে আমরাও খুব বেকায়দায় আছি। আমাদের উপাচার্য পুরো হতাশ হয়ে গেছেন। একবার সভাপতি দেওয়া হয়, তার নামে অভিযোগ আসে। পরিবর্তন করলে আরেকজন আবার ওপর থেকে ফোন করান। ফলে একজনকে বাদ দিয়ে আরেকজনকে দিতে হয়। আমাদের কোনো দোষ নেই। এখন এসব বাদ দিয়ে সভাপতি পদে নির্বাচন করতে বলছি। নির্বাচন করে সমাধান করতে হবে।