সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ এবং ডিজিটাল স্পেসে নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় বহুল আলোচিত-সমালোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩’ বাতিল করে নতুন ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ’ জারি করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মহলে বিতর্কিত ধারাগুলোর অপব্যবহার ও হয়রানির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এই আইন বাতিল করে নতুন অধ্যাদেশ কার্যকর করলো।
বুধবার (২১ মে) রাতে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগের সচিব ড. হাফিজ আহমেদ চৌধুরী অধ্যাদেশে স্বাক্ষর করেন। এরপর একই দিন আইন মন্ত্রণালয় থেকে এর গেজেট প্রকাশ করা হয়।
নতুন ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫’–এ ২০২৩ সালের বাতিল হওয়া আইনের ৯টি ধারা সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো: ধারা ২১, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩১ ও ৩৪। এসব ধারায় চলমান মামলা, তদন্ত ও কার্যক্রম বাতিল এবং আদালত বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত দণ্ড-জরিমানা নিষ্ক্রিয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
বাদ পড়া ধারাগুলোর মধ্যে ছিল জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় পতাকা বা সংগীত নিয়ে বিভ্রান্তিকর ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণার অপরাধ; পরিচয় প্রতারণা বা ছদ্মবেশ ধারণ; আক্রমণাত্মক ও ভীতিকর তথ্য প্রচার; অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবহার; এবং মানহানিকর তথ্য প্রচার সংক্রান্ত বিধান। এসব ধারা পূর্বের আইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের অভিযোগ এনে অনেক নাগরিক ও সংগঠন সমালোচনা করেছিল।
অধ্যাদেশে নতুনভাবে ইন্টারনেটকে নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অনলাইন জুয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং নারী ও শিশু নির্যাতন ও যৌন হয়রানিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধও এখন থেকে আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কেউ যদি অনলাইনে জুয়া খেলায় অংশগ্রহণ করেন, জুয়া পরিচালনা করেন বা এর পক্ষে বিজ্ঞাপন দেন, তাহলে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
অধ্যাদেশে ধর্মীয় বা জাতিগত বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, সহিংসতা ও ঘৃণার উৎস প্ররোচনার মতো অপরাধের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। মতপ্রকাশ সংক্রান্ত মামলাগুলো জামিনযোগ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা পূর্বের আইনে ছিল না।
জানা গেছে, অধ্যাদেশের খসড়া তৈরিতে সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে মোট ২৫ বার সংশোধনী এনেছে। সর্বশেষ গত ৬ মে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সংশোধিত খসড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয় জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে।
তবে পুরো আইন বাতিল না করে ২০২৩ সালের সাইবার নিরাপত্তা আইনের ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২২, ২৩, ৩০, ৩২ ও ৩৫ ধারাসমূহ বলবৎ রাখা হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই অধ্যাদেশ একদিকে যেমন ডিজিটাল অপরাধ দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে, অন্যদিকে নাগরিকের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকারের ভারসাম্য রক্ষার একটি নতুন দৃষ্টান্তও স্থাপন করতে পারে।