নীলফামারীর সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার প্রধান ফটকের মাত্র দুইশ গজ দুরত্বে অভিজাত রেলকলোনী সাহেব পাড়া। আর এ সাহেব পাড়ার সরকারি বাংলোগুলো আজ শ্রমিকলীগ ও স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাদের দখলে। এগুলো উদ্ধারে যেন বড় অসহায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ন সম্পাদক ও সাবেক পৌর কাউন্সিলর জোবায়দুর রহমান শাহীন। তার গ্রামের বাড়ী শান্তাহার। তিনি রেলওয়ের সম্পত্তি বিক্রি করে আজ কোটিপতি বনে গেছে। এখনো তার দখলে রেলওয়ের কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে।
তবে ৫ আগস্টের পর থেকে সে পলাতক রয়েছে।
সৈয়দপুর রেলকারখানা সংলগ্ন সাহেব পাড়া। এ পাড়ায় রয়েছে ব্রিটিশদের হাতে গড়া রেলওয়ে কারখানায় কর্মরত অফিসারদের জন্য ১৫ টি বহুতল বাংলো। চুন সুড়কী মিশ্রিতে গড়া লাল রঙের স্থাপনা মূলত এ মুঘল আমলের কারুকার্য খচিত রাজপ্রাসাদ সাদৃশ্য। এ সকল বহুতল বাংলোর মধ্যে অধিকাংশই চার ইউনিট। রেলওয়ে কারখানার প্রতিটি সোপের ইনচার্জ বা সহকারী প্রকৌশলীগণ তাদের পরিবার নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করেন। এ সকল বাংলোর সামনে রয়েছে প্রায় দুই একরের মত জায়গা জুরে বাগানবাড়ি। নিরাপত্তা ও বাগানে কাজের জন্য রয়েছে পৃথক কক্ষ ও আউট হাউস ক্যাম্প। রেলওয়ে কারখানায় যাতে নতুন উদ্ভাবনা সৃষ্টিতে রেলকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে এর জন্য ব্রিটিশ শাসকরা সকল সুবিধা প্রদান করতেন প্রকৌশলীসহ তার পরিবারগনকে। ধারাবাহিকতায় ইংরেজ শাসনামল থেকে ভারত, পাকিস্তান ও শেষে স্বাধীন বাংলাদেশে আভিজাত্য নিয়ে ইনচার্জ তথা সাহেবরা দেড় শতাব্দী ধরে বসবাস করে আসছেন এ বাংলোতে। তবে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দীর্ঘ ১৭ বছরে সব কিছুই বেদখল হয়ে যায়। ১৫টি বাংলোর মধ্যে মাত্র ৪টি বাংলোর ৪ ইউনিটে ১‘৬ পরিবার বসবাস করেন। বাকি ১১টি বাংলোর ৩৬টি ইউনিটের বসবাস করছেন রেলের ১১ বৈধ শ্রমিক। বাকি ২৫ ইউনিটে বসবাস করছেন বহিরাগতরা। সোপ ইনচার্যদের নামের বাংলোগুলো রেলকতৃপক্ষকে ভুল বুঝিয়ে শ্রমিকের নামে বরাদ্দ নিয়ে স্বল্প ভাড়ায় বসবাস করছেন অনেক অফিসার। এতে রেল যুগের পর যুগ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সরেজমিন দেখা যায়, এল-২৩ নং বাংলোটি রয়েছে ফাউন্ড্রি সোপের রবিউল ইসলাম নামের খালাসি পদে কর্মরত শ্রমিকের নামে। যার টিকিট নং-৪৬৬২। তবে বাংলোতে বসবাস করছেন ওই সোপের ইনচার্জ খয়রাত হোসেন। তার বাংলোর পাশে টিনশেড ঘর বানিয়ে ভাড়া দেয়া হয়েছে। তবে তার বিশাল বাগানটি জঙ্গলাকীর্ণ।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা গ্রেড অনুযায়ী যে বেতন পাই। সেখান থেকে ১৪ হাজার টাকা দিতে হত। খালাসির নামে থাকায় দিতে হচ্ছে মাত্র ৭ হাজার টাকা। তবে ৩ একর জায়গায় ওই বাংলোটির পরিবেশের অবস্থা ভয়ংকর। রাত হলেই মাদকসেবী ও অপরাধীদের আড্ডা বসে। নানা কারণে অফিসাররা বাংলোয় বসবাস না করায় খালাসির নামে বরাদ্দ নিয়ে অনেকে বসবাস করছেন। একটি সুত্র জানায়,ওই বাংলো গুলো শুধুমাত্র অফিসারদের নামে বরাদ্দ হবে। অফিসার ব্যতীত কোনক্রমেই নিম্ন কর্মচারির নামে ওই বাংলো বরাদ্দের সুযোগ নেই। কিভাবে অফিসার বাংলো নিম্ন কর্মচারির নামে বরাদ্দ দেয়া হল তা সন্দেহাতীত।
এল ২৪ নং বাংলোটি রয়েছে জিওএইচ সোপের খালাসি সাইদুর রহমানের নামে। এক ইউনিটের ওই বাংলোতে তিনি বসবাস করছেন। তার বাংলোসহ এল ২৫ ও ২৬ নম্বর বাংলোর সামনের বিশাল বাগানবাড়িটিতে করা হয়েছে নেপিয়ার ঘাসের চাষ।
ওই এলাকার অনেকেই বলেন, বাংলোর সামনের বাগানে ঘাস রোপণ করেছেন মোখছেদুল মোমিন। তিনি ছিলেন সৈয়দপুর রেল শ্রমিক লীগের দীর্ঘ দিনের সাধারণ সম্পাদক ও সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
শুধু তিনিই নন,আওয়ামী নেতাদের দখলে গেছে পুরো সাহেবপাড়া। তারা বাংলোগুলোর সামনে ও ডান-বামের জায়গা দখলে নিয়ে বিক্রি করেছেন লাখ লাখ টাকায়। এতে বাংলো এলাকা বস্তিতে পরিণত হয়েছে। সামনে হাটলেও দৃশ্যমান হয় না বাংলোগুলো।
সৈয়দপুর রেল শ্রমিকলীগ নেতা তরুণ কুমার মন্ডল একইভাবে টি ১৪ নামের বাংলোতে রেল ভাড়া না দিয়ে দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে অবৈধভাবে বসবাস করছেন। শুধু তাই নয়, তার সামনের ৩০ শতক জায়গায় ১০ কক্ষ বিশিষ্ট বাড়ি করে ভাড়া দিয়েছেন।
একইভাবে রেল শ্রমিকলীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. সালেহ উদ্দিন এল ৩৮ বাংলোটিতে তার জামাতাকে রেখেছেন। বাকি ৩ ইউনিট ভাড়ায় দিয়ে ১৭ বছরে লাখ লাখ টাকা পকেটে ভরেছেন। এল ১২৪ নং বাংলোর ১টি ইউনিট রয়েছে রেল শ্রমিক লীগ নেতা নান্নান শরিফের ছেলে ফয়সাল শরিফের নামে। বাকি ৩টি ইউনিট ভাড়ায় দিয়েছেন।
শ্রমিক লীগ নেতা মোঃ জহির উদ্দিন বাংলোর জায়গা দখলে নিয়ে বিলাসবহুল বাড়ি করেছেন। শুধু তারাই নয়, স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী রেলে চাকরি না করেও প্রভাব খাটিয়ে এল ৩৯, ১৪১, ১২৯, ৩৭, ৩৮, ১২৪, ২৫, ২২ ও ৩৬ নং বাংলোগুলো দখলে নিয়ে অবৈধভাবে বসবাস করছেন।
এ নিয়ে বাংলোগুলোর দায়িত্বে থাকা আইডাব্লু মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, আমার আসার আগে এই অবস্থা হয়েছে বাংলোগুলোর। এই বাংলো বিষয়ে উর্ধ্বতনদের অবহিত করা হয়েছে। একই কথা বলেন, সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার ব্রাক মাস্টার জোনাব আলী। এ সকল বাংলোর সামনের জায়গা দায়িত্বে থাকা পার্বতীপুর রেল ভূমি অফিসের কানুনগো মো.শরিফুল ইসলাম বলেন, আমার এখানে আসার মাত্র এক মাস হল। সৈয়দপুরে রেলওয়ের অফিসার বাংলো থেকে শুরু করে জমি,জলাশয় দখল ও বিক্রির সাথে বেশ কিছু রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা,কর্মচারি ও রেলওয়ে কারখানার শ্রমিক সংগঠনের নেতারা জড়িত। এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারি ও শ্রমিকজোট নেতা শফিকুল ইসলাম মোমিন,একের পর এক রেল কোয়ার্টার দখল করে বিক্রি করে আজ কোটিপতি। তিনি শহরের মুন্সিপাড়ায় বেশ কয়েকটি কোয়ার্টার বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। এখনো তার দখলে আতিয়ার কলোনীর কয়েকটি কোয়ার্টার। তিনি নিজেও বসবাস করছেন একটিতে। দখলে রেখেছেন আরো কয়েকটি। অথচ রেলওয়ের ব্রাকমাস্টার নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়।