নওগাঁর মহাদেবপুরে বালু সিন্ডিকেটের চাঁদাবাজী নিয়ে সাবেক এক বিএনপি নেতার সাথে যুবদল নেতার একটি কলরেকর্ড এবং এবিষয়ে একজন কর্মকর্তার অপর একটি কলরেকর্ড ফাঁস হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিষয়টি ভাইরাল হয়। এনিয়ে স্থানীয় জনমনে ও প্রশাসনে চলছে তোলপাড়। ওই কলরেকর্ডে শোনা যায়, উপজেলা বিএনপির সাবেক সহ-দপ্তর সম্পাদক এনায়েতপুর ইউনিয়নের পাটকাটি গ্রামের আলহাজ্ব আব্দুল আজিজ আফান ও এনায়েতপুর ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাসান এর কন্ঠ।
কলরেকর্ডে হাজী আফান যুবদল নেতা হাসানকে ‘আব্বা...’ বলে সম্মোধন করেন। জবাবে হাসান তাকে ‘হ্যাঁ ভাই‘ বলে কথা শুরু করেন। হাসান জিজ্ঞাসা করেন কত দিবো। হাজী আফান ২০ হাজার টাকা শাহাদতকে দিতে বলেন। হাসান বলেন, জিয়া বাজারের বাবু ফোন দিচ্ছে। ওরাও এক গ্রুপ। ওরাও টাকা চাচ্ছে। এখন কাকে টাকা দিবো, কে গাড়ী আটকাবে। এ পর্যায়ে হাজী আফান ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, বাবু আসতে পারবে?, আসুক দেখি, কত ক্ষমতা।
৩ মিনিট ৩০ সেকেন্ডের কল রেকর্ডে এক পর্যায়ে হাসান জানিয়ে দেন রাত ৮টার আগে তিনি টাকা দিতে পারবেন না। হাজী আফান তাহলে গাড়ী বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। তিনি শাহাদতকে বলে দিচ্ছেন এক্ষুনি গাড়ী বন্ধ করে দিবে।
স্থানীয়রা জানান, গতবছর মহাদেবপুরে আত্রাই নদীর উজান অংশের বালুমহাল ইজারা দেয়া হয় নওগাঁ জেলা যুবলীগের নেতা ও সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব রফিকুল ইসলাম রফিকের স্ত্রী মালেকা পারভীনের নামে। ৫ আগস্টের পর রফিকুল ইসলাম পালিয়ে গেলে পুরো আত্রাই নদীতে কমপক্ষে ২০টি নতুন পয়েন্ট তৈরি করে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা শক্তিশালী খননযন্ত্র বসিয়ে অবৈধভাবে ভূগর্ভস্থ বালু উত্তোলন করে বিক্রি করা শুরু করেন। এভাবে হরিলুট হয় আত্রাই নদীর বালুমহাল। ৩০ চৈত্র ইজারার মেয়াদ শেষ হয়। স্থানীয়দের মানববন্ধনের পর এবছর আর নতুন করে ইজারা দেয়া হয়নি। কিন্তু ইজারা না থাকলেও প্রতিদিন রাতে এসব পয়েন্ট থেকে বালু ও মাটি চুরি করে বিক্রি করছে বালু সিন্ডিকেট। তারা বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে প্রতিদিন লুটে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা।
সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ১৩ মে নুরপুর পয়েন্ট থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে চুরি করে বালু উত্তোলন করে ট্রাক্টরযোগে পরিবহণ করছিলেন যুবদল নেতা হাসান। হাজী আফান তার ছেলেদের জন্য শাহাদৎ হোসেনের কাছে ২০ হাজার টাকা দিতে বলেন হাসানকে। হাসান দিতে অস্বীকার করলে হাজী আফান বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে জানান। অভিযোগ পেয়ে ইউএনও মো: আরিফুজ্জামান ওইদিন বিকেলে নুরপুর বালুর পয়েন্টে গিয়ে অভিযোগের সত্যতা পান। সেখানে বালু পরিবহণের কাজে ব্যবহৃত কয়েকটি ট্রাক্টর জব্দ ও যুবদল নেতা হাসানকে আটক করে নিয়ে আসেন। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতে হাসানের ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এরপরই হাসান তার সাথে কথা বলা হাজী আফানের ২০ হাজার টাকা দিতে বলার কলরেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেন।
জানতে চাইলে হাসান জানান, ব্যক্তি মালিকানার জমি থেকে তিনি বালু ও মাটি তুলছিলেন। সাংবাদিক শ্রী সুমন কুমার বুলেট ও হাজী আফান তার পয়েন্টে গিয়ে ছবি ও ভিডিও ধারণ করে খবর প্রকাশ করার হুমকি দেন এবং সাংবাদিক ও বিভিন্ন জনের নাম করে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন।
হাজী আফান নিজেকে বিএনপির নেতা পরিচয় দিয়ে বলেন, অবৈধভাবে লক্ষ লক্ষ টাকার বালু তোলাকে কেন্দ্র করে গ্রামের ছেলেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। তিনি চেয়েছেন উভয়পক্ষ মিলেমিশে কাজ করুক। এজন্য হাসানকে শাহদৎ হোসেনের কাছে ২০ হাজার টাকা দিতে বলেছিলেন। তিনি কোন চাঁদা চাননি বলেও দাবি করেন।
সাংবাদিক সুমন কুমার বুলেটের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। শাহাদৎ হোসেন জানান, তিনি অবৈধ বালু উত্তোলনের প্রতিবাদ করেছেন। তিনি চুরি করা বালু পরিবহণের সময় গাড়ী আটকিয়েছিলেন। কিন্তু একজন কর্মকর্তা তাকে ফোন দিয়ে গাড়ী ছেড়ে দিতে বলেন। তারপর থেকে প্রতিদিন রাতে এখান থেকে বালু ও মাটি চুরি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি ওই কর্মকর্তার সাথে তার কথা বলার কলরেকর্ডটি বিভিন্ন জনের কাছে সরবরাহ করেন। ওই কল রেকর্ডে শোনা যায়, একজন সরকারি কর্মকর্তা বলছেন, ‘‘আপনি কি শাহাদৎ বলছেন? আপনি গাড়ী আটকিয়েছেন কেন, হু আর ইউ?” শাহাদৎ হোসেন বলেন, ‘‘স্যার আপনার অনুমতি থাকলে তো আমাদের কিছু করার নাই।” কর্মকর্তা বলেন, ‘‘হ্যাঁ আমার অনুমতি আছে, আপনি গাড়ী ছেড়ে দেন।” এই কলরেকর্ডের বিষয়টিও ট্যক অব দ্য টাউনে পরিণত হয়। তবে কলের অপরপ্রান্তের কন্ঠ সঠিক কিনা তা যাচাই করা যায়নি।
স্থানীয়রা জানান, শনিবার (২৪ মে) দিবাগত রাতেও উপজেলার বুড়া শিবতলাসহ বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে চুরি করে আত্রাই নদীর বালু উত্তোলন করে পরিবহণ করা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এব্যাপারে জানিয়েও এসব বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। চুরি করে বালু উত্তোলন, কলরেকর্ড ফাঁস প্রভৃতি বিষয় নিয়ে এলাকায় দারুন উত্তেজনা চলছে। যে কোন সময় স্থানীয়দের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজনৈতিক কারণে প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে এসব বালু চুরি করা হচ্ছে। স্থানীয়রা নিজেদের উদ্যোগে এসব বন্ধের চেষ্টা করলে তাদেরকেও নিরুৎসাহীত করা হচ্ছে। তারা দাবি করেন, বালু চুরির বিচার হলেও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কোনই ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এসব বন্ধ না হলে বড় ধরণের বিপর্যয়ের সম্মুখিন হতে হবে।
জানতে চাইলে রোববার (২৫ মে) দুপুরে মোবাইলফোনে নওগাঁর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সোহেল রানা জানান, বিষয়টি তিনি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবেন।
বিএনপি-যুবদল নেতারা বালু চুরি ও চাঁদাবাজীর সাথে জড়িয়ে এলাকায় ভাইরাল হওয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলে ছি, ছি রব উঠেছে। তবে বিএনপি নেতারা এসব অস্বীকার করেছেন। উপজেলা বিএনপির একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, হাজী আফান গত এক যুগ থেকে ইনএ্যাক্টিভ। ৫ আগস্টের পর তিনি সদর ইউনিয়ন কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক সুমন কুমার বুলেটকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিনিয়ত নানান অনৈতিক কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার সাথে উপজেলা বিএনপির কোন সম্পর্ক নেই। এছাড়া এনায়েতপুর ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাসানের ব্যক্তিগত কর্মকান্ডের দায়ও উপজেলা বিএনপির নয়। দলের একটি গ্রুপ বিভিন্ন স্থানে অনিয়ম করে যাচ্ছে। এদের ব্যাপারে স্থানীয়দের সচেতন থাকার পরামর্শ এই নেতার।