বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের অন্যতম প্রধান অংশ-বনভূমি-আজ মারাত্মক সংকটে। পত্রপত্রিকার প্রকাশিত খবরাখবর থেকে জানা যায়, দেড় লক্ষাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দখলে রয়েছে প্রায় ২ লাখ ৫৭ হাজার একর বনভূমি, যার বাজারমূল্য প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা। শুধু সংরক্ষিত বনভূমিই দখল হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার একরের বেশি। এটি নিঃসন্দেহে দেশের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং দীর্ঘমেয়াদে জনজীবনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে। এই দখলদারির পেছনে যেমন ব্যক্তি ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ভূমিকা রয়েছে, তেমনি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোরও রয়েছে উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খামার, শিল্পকারখানা এমনকি সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্যও বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অনেকে তিন পুরুষ ধরে দখল করে আছেন, যা একটি সুপরিকল্পিত প্রশাসনিক উদাসীনতারই প্রমাণ। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সীমিত সময়ের মধ্যে বনভূমি উদ্ধারে দৃশ্যত কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। গঠিত হয়েছে বিশেষ টাস্কফোর্স, আদালতের স্থগিতাদেশ থাকা জমিতে উচ্ছেদ কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতা থাকলেও কক্সবাজার ও গাজীপুরসহ কয়েকটি স্থানে উল্লেখযোগ্য কিছু জমি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। কক্সবাজারে ফুটবল ফেডারেশন, লোকপ্রশাসন একাডেমি ও বেসরকারি ক্যাডেট কলেজের জন্য বরাদ্দ বাতিল করে জমি বন বিভাগের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, নয় মাসে উদ্ধার হয়েছে মাত্র ১ শতাংশেরও কম জমি। এই গতি বনভূমি রক্ষায় যথেষ্ট নয়। একদিকে প্রশাসনের ভেতরে থাকা দুর্নীতিবাজ অংশের সহায়তায় জমি দখল অব্যাহত, অন্যদিকে মামলা পরিচালনায় বন বিভাগের আগ্রহের অভাব উদ্বেগজনক। পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের বক্তব্য অনুযায়ী, আইনগত ও লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বনভূমি উদ্ধারে একটি দীর্ঘমেয়াদি, রাজনৈতিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ কৌশল প্রয়োজন। শুধুমাত্র বর্তমান সরকারের সীমিত মেয়াদি কিছু উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুনির্দিষ্ট সময়সীমায় লক্ষ্য নির্ধারণ এবং আইনি কাঠামো জোরদার করে প্রকৃত দখলদারদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। বনভূমি শুধু জমি নয়, এটি জলবায়ু, জীববৈচিত্র্য, কৃষি এবং মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। তাই এটি উদ্ধারের বিষয়কে অর্থনৈতিক মূল্যায়নের সীমায় না বেঁধে পরিবেশগত ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ‘ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানি’ নীতির বদলে চাই সুদৃঢ় পদক্ষেপ। দেশবাসীর প্রত্যাশা, বনভূমি উদ্ধারে নেওয়া উদ্যোগগুলি যেন দায়সারা কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধ না থেকে স্থায়ী ও ফলপ্রসূ হয়।