গুমের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারকে আর্থিকভাবে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। এছাড়া এখনও গুম থাকা তিন শতাধিক ব্যক্তিকে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। আর তারা জীবিত না থাকলেও সেটিও রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের পরিবারকে জানাতে হবে। এটি করতে ব্যর্থ হলে দেশে আবারও ফ্যাসিবাদি শাসন ব্যবস্থা কায়েম হবে এবং গুমের সাংস্কৃতি ফিরে আসবে।
দেশের অন্যতম শীর্ষ মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ খুলনা ইউনিট আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এসব দাবি জানানো হয়। গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে এবং গুমের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবীতে আন্তর্জাতিক সপ্তাহ উপলক্ষে শনিবার (৩১ মে) বেলা ১১ টায় খুলনা প্রেস ক্লাবের সামনে এ মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়।
মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী কে.এম. জিয়াউস সাদাত। সঞ্চালনা করেন ‘অধিকার’ খুলনা ইউনিটের ফোকাল পার্সন সাংবাদিক মুহাম্মদ নূরুজ্জামান। অধিকার’র বিবৃতি পড়ে শোনান মানবাধিকার কর্মী জি.এম. রাসেল ইসলাম।
মানববন্ধনে গুমের শিকার হয়ে ফিরে আসা খুলনার টুটপাড়ার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. ইমরান হোসেন তার বক্তব্যে বলেন, তিনি ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নগরীর ধর্মসভা মসজিদ থেকে এশার নামাজ পড়ে পিকচার প্যালেস মোড়ে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ফেরার সময় সাদা পোশাকে র্যাব সদস্যরা চোখ ও হাত বেঁধে একটি গাড়ীতে করে তাকে গুম করে। পরে সেখান র্যাব-৬’র (তৎকালীন নিউজপ্রিন্ট মিল) কার্যালয়ে এবং পরবর্তীতে ঢাকার উত্তরায় র্যাব-১’র কার্যালয়ে নিয়ে রাখা হয়। তাকে জয়েন্ট ইন্টারগেশন সেলে জিজ্ঞাসাবাদের নামে ক্রস ফায়ারে হত্যার ভয় দেখিয়ে ‘জঙ্গি’ বলে স্বীকার করতে অমানসিক নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনে তার কানের তালা ফেঁটে যায়। যে নির্যানের যন্ত্রণা এখনও তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন। এভাবে দীর্ঘ এক মাস ২৩ দিন পর সন্দেহজনক ঘোরাফেরার অভিযোগে তাকে ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে ২৫ মার্চ উত্তরা থানায় সোপর্দ করা হয়। তিনি তার গুমের সঙ্গে জড়িত র্যাবের মেজর শফিউল আজমসহ সকলের কঠোর শাস্তি দাবি করেন। একই সঙ্গে ক্ষতিপূরণ দাবি করেন।
মানববন্ধনে পাঠকৃত অধিকার’র বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন কর্তৃত্ববাদী সরকার রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে গুমকে ব্যবহার করেছে। পতিত হাসিনার শাসনামলে সারা দেশে বেআইনীভাবে আটক রাখার বন্দিশালা তৈরি করা হয়। এসব অবৈধ গোপন বন্দিশালায় বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ভিন্নমতাবলম্বী এবং তথাকথিত ‘জঙ্গিদের’ আটক করে রাখা হতো। এরমধ্যে আলোচিত গোপন বন্দিশালা হলো ডিজিএফআই এর জয়েন্ট ইন্টারগেশন সেন্টার এবং র্যাবের বন্দিশালা। এই বন্দিশালাগুলোতে হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরোধীতাকারী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং ভারতের স্বার্থের বিপক্ষে মূলত যাঁরা সোচ্চার ও প্রতিবাদী হতেন তাঁদেরই গুম করে নির্যাতন করা হতো। গুমের শিকার অনেক ব্যক্তি এখনও ফিরে আসেনি, যারা ফেরত এসেছেন তাঁদের অনেককে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে এবং অনেককে নির্জন সেলে আটকে রাখা হয়েছে। গুমের শিকার ব্যক্তিদের উপর প্রচন্ড শারিরীক এবং মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে এবং গুমের পর অনেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। অধিকার গুমের শিকার ব্যক্তিদের ফিরে পাওয়ার দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচীসহ আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে আসছে এবং এই কারণে অধিকার এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার কর্মীরা কর্তৃত্ববাদী হাসিনা সরকার কর্তৃক নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
মানববন্ধনে অধিকার’র পক্ষ থেকে সরকারের কাছে পাঁচ দফা দাবী তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হচ্ছে- গুমের শিকার যে সব ব্যাক্তি ফেরত আসেননি তাঁদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা জনগনকে জানানো, যে সকল গুমের শিকার ব্যক্তি এখনও ফিরে আসেনি, তাঁদের স্ত্রী-সন্তানরা যাতে গুম হওয়া ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব পরিচালনা এবং স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি এবং ভোগ করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে, গুমের পর কিছু ব্যাক্তিকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং পরে তাঁদের পাওয়া গেছে। তাই ভারতে আরো গুমের শিকার ব্যাক্তি আছেন কি-না সে বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের সাথে কূটনৈতিক পর্যায়ের যোগাযোগ স্থাপন করে তা জানা, যে সকল ব্যক্তি গুমের পর ফেরত এসেছেন, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এমনকি কাউকে কাউকে মিথ্যা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বা নির্যাতন করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করে নিম্ন আদালতকে ব্যবহার করে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়েছে। এ সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে এবং কারাগার থেকে মুক্তি দিতে হবে এবং গুমের সঙ্গে জড়িত সকল ব্যক্তিকে আইনের আওতায় এনে তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার করতে হবে।
মানববন্ধনে বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে’র সহকারী মহাসচিব ও দৈনিক আমার দেশ’র খুলনা ব্যুরো প্রধান এহতেশামুল হক শাওন, বিএফইউজে’র সাবেক সহ-সভাপতি ও দৈনিক মানবজমিনের স্টাফ রিপোর্টার মো. রাশিদুল ইসলাম, মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন খুলনার কোষাধ্যক্ষ ও দৈনিক সংগ্রামের খুলনা ব্যুরো প্রধান আব্দুর রাজ্জাক রানা, গণসংহতি আন্দোলনের খুলনা জেলা শাখার আহবায়ক মুনীর চৌধূরী সোহেল, খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব এ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার, ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আল-আমিন শেখ, গুমের শিকার হয়ে ফিরে আসা খুলনার টুটপাড়ার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. ইমরান হোসেন ও খুলনা ব্লাড ব্যাংকের সভাপতি শেখ মো. ফারুক।
মানববন্ধনে অন্যান্যের মধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ খুলনা মহানগর শাখার সহ-সভাপতি শেখ মুহা. নাসির উদ্দিন, মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন খুলনার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসান হিমালয়, বানিয়াখামার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রবিউল ইসলাম, খুলনা প্রেস ক্লাবের নির্বাহী সদস্য ও একুশে টেলিভিশনের খুলনা প্রতিনিধি আশরাফুল ইসলাম নূর, মানবাধিকার কর্মী এ্যাডভোকেট মো. শহীদুল ইসলাম, মানবকণ্ঠের খুলনা ব্যুরো প্রধান মো. জামাল হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সিবিএ খুলনার সভাপতি মো. মাহবুবুর রহমান, সিনিয়র সাংবাদিক মো. আব্দুল হান্নান, মো. আমিরুল ইসলাম, মো. সাইফুল ইসলাম, মো. মিশারুল ইসলাম মনির, এসএম জসিম উদ্দিন, ব্যবসায়ী মোস্তফা কামাল রিপন, মো. হাবিবুর রহমান, নূর মোহাম্মদ লিটু, এবিএম ফারুক হোসেন, মো. হাফিজ, কলেজ ছাত্র আরিফুল হাসান রিয়াদ, মো. সজল, মো. সাদ্দাম হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।