অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজশাহীর তানোরে ইউএনও’র কাঁধে এসিল্যান্ড ও দু’টি পৌরসভার প্রশাসক ছাড়াও বেশ কয়েক’শ স্কুল কলেজ সভাপতির পদের ভার পড়েছে। ফলে ব্যাপক ব্যস্ততায় নাওয়া খাওয়া ভুলে নিয়মিত জেলা কমিটির বিভিন্ন সভায় উপস্থিত থাকতে হচ্ছে তাঁকে। তবে, বিশেষ করে গেলো ২৯ এপ্রিল এসিল্যান্ড মাশতুরা আমিনা অন্যত্র বদলি হবার পর আরও বেশি চাপে পড়েছেন ইউএনও লিয়াকত সালমান।
এতো দায়িত্বের ভরে উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর ভূমি অফিসে বসার সময় পান না তিনি। ফলে সাধারণ মানুষ কিছুটা হয়রানি ও বিড়ম্বনায় পড়েছেন। অবিলম্বে দ্রুত সময়ের মধ্যে এসিল্যান্ড নিয়োগ প্রদানে জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারকে অনুরোধ জানিয়েছেন উপজেলাবাসি।
সংশ্লিষ্ট সত্রে জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়র ছাড়াও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরই মাঝে সম্প্রতি গেলো ২৯ এপ্রিল এসিল্যান্ড মাশতুরা আমিনা অন্যত্র বদলি হন। এরপর অতিরিক্ত দায়িত্বে পান ইউএনও। এমন দায়িত্ব পেয়ে সময়ের অভাবে এসিল্যান্ড অফিসে বসার সময় হয়নি। শুধু এই অফিসে নয়, তানোর ও মুন্ডুমালা পৌরসভার প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পড়েছে তার কাঁধে।
এছাড়াও বিভিন্ন দপ্তরের স্থায়ী কমিটির ৯টিতে নারী ভাইস চেয়ারম্যান আর আটটিতে পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান সভাপতির দায়িত্ব পালন করতেন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কয়েকটি কমিটিতে উপদেষ্টা এবং ৮ থেকে ১০টি কমিটির সভাপতির দায়িত্বে থাকেন। তবে তারা না থাকায় সব কমিটির দায়িত্ব এখন ইউএনওর কাঁধে। এসব তথ্য উপজেলা পরিষদের অফিস সহকারী সূত্রে জানা গেছে।
অপরদিকে, এ উপজেলায় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ রয়েছে একটি করে দু’টি। পদাধিকার বলে ইউএনও সভাপতি। ১২টি বে-সরকারি কলেজের মধ্যে দুয়েকটি ছাড়া সব কলেজের সভাপতি ইউএনও। আর এমপিওভুক্ত দাখিল মাদ্রাসা ২০টি। ননএমপিও ৬টি। এছাড়াও নন-এমপিও নিম্ন মাধ্যমিক ৬টি। অপরদিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১২৮টি। তবে, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৪ জন এটিও সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। আর মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৫৪টি। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোন অনিয়ম হলে অভিযোগ পড়ে। অভিযোগের বিষয়ে সুরহা করতে হচ্ছে ইউএনওকে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতার কাগজে স্বাক্ষর করতে হয় ইউএনওকে। দেখতে হয় তাদের ফাইলপত্রও। কোনো প্রতিষ্ঠানের মামলা থাকলে সেখানে বাড়তি সময় ব্যয় হয়। এছাড়া উপজেলা শিক্ষা কমিটির সভাপতি হিসেবে তাঁকে দায়িত্বও সামলাতে হচ্ছে। জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটি না থাকায় এভাবে দায়িত্ব সামলাতে গলদঘর্ম অবস্থা ইউএনওর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পদ দখলের প্রতিযোগিতা চলে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর মধ্যে। এজন্য আর্থিক লেনদেন থেকে অনেক ধরনের ঘটনা ঘটে। পদ না পেলে দাঙ্গা-হাঙ্গামাও বেধে যায়। শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। শেষে এসব পদের দায়িত্ব সামলান দলীয় নেতারা। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন তাদের সে সুযোগ নেই। পদাধিকার বলে সব সভাপতি পদের দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন ইউএনও।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে ইউএনওর ওপর চাপ কমাতে কিছু কাজ অন্য সরকারি কর্মকর্তাদের দেওয়া যেতে পারে। কারণ ইউএনওর পদটি এলাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাঁকে চাপমুক্ত রাখলে ভালো সেবা পাওয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দপ্তর সেনা কর্মকর্তারা দেখতে পারেন। কাজে লাগানো যেতে পারে সুধী সমাজের প্রতিনিধিদের। এসব বাস্তবায়নে সরকারের ওপর মহলের সিন্ধান্ত এবং নির্দেশনা প্রয়োজন।
জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা কমিটি থেকে শুরু করে শিক্ষা, কৃষি উন্নয়ন, প্রতিবন্ধী ভাতা, হাটবাজার ব্যবস্থাপনা, বয়স্ক-বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি, মাতৃত্ব ভাতা, চোরাচালান প্রতিরোধ, এনজিও সমন্বয়, টেন্ডার, টিআর-কাবিটা, বিভিন্ন দিবস উদযাপন ও ভিডব্লিউবিসহ উপজেলা পর্যায়ে সরকারি দপ্তরগুলোর বিভিন্ন কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ইউএনও। এখন সমন্বয় সভাও পরিচালনা করতে হচ্ছে। সঙ্গে বেশ কিছু মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব তাদের কাঁধে।
শিক্ষা অফিস থেকে জানা গেছে, রাজনৈতিক সরকার থাকলে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পছন্দের লোককে সভাপতি বানানো হয়। এ সুযোগে দলীয় প্রভাবে অনেকে সভাপতি হন। কিন্তু এখন রাজনৈতিক সরকার না থাকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি পদ থেকে দলীয় লোক বাতিল করা হয়েছে। তবে, ১২৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চারজন এটিও সভাপতি পদে রয়েছে। আর অন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন ইউএনও।
উপজেলা পর্যায়ে একজন ইউএনও স্বাভাবিকভাবে ৪০ থেকে ৪৫টি কমিটির সভাপতি থাকেন। এর সঙ্গে এখন আরও অন্তত দেড়শ পদে ভারপ্রাপ্ত ও অতিরিক্ত হিসেবে দায়িত্বে আছেন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও তাঁর কাঁধে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পৌরসভার দুইজন কর্মকর্তা বলেন, পৌর প্রশাসকের দায়িত্বে ইউএনওকে রাখা উচিত নয়। বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় পৌর কার্যালয়ে বসার সময় পান না তিনি। ফলে বিভিন্ন ফাইলপত্রে তাঁর স্বাক্ষর নিতে ইউএনও অফিসে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে বসে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এরপরও সময় মতো মিলে না স্বাক্ষর। এতে নাগরিক সেবায় মানুষ হয়রানি ও বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে।
উপজেলার সরকারি দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এতগুলো পদের দায়িত্বে থাকার কারণে ইউএনওর স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে। কাজের চাপে এবং সময় স্বল্পতায় অধিকাংশ কমিটির সভায় হাজির হতে পারেন না তিনি। বাধ্য হয়ে এসব কমিটির সভার রেজুলেশনে বা প্রয়োজনীয় কাগজে পরে স্বাক্ষর করেন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, সভাপতি ছাড়াই সভা করতে হয়। তাঁর স্বাক্ষর নিতে হয় সভা শেষে। এতে সেবা নিতে আসা মানুষের কাজে বিলম্ব হয়।
ইউএনও এবং এসিল্যান্ড ছাড়াও পৌর কার্যালয়ের একাধিক অফিস সহকারীর ভাষ্য, তারা বাড়তি কাজের চাপে আছেন। অনেক সময় ফাইলপত্র নিয়ে ইউএনও অফিসে সন্ধ্যা, এমনকি রাত অবধি কাজ করতে হয়। ইউএনও অতিরিক্ত সময় নিয়ে অফিস করছেন। তিনি থাকলে কর্মচারী হয়ে তাদেরও আগে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ নেই। এ জন্য বাড়তি ভাতা না থাকলেও কাজ করতে হচ্ছে। কষ্ট হলেও দিনের কাজ দিনে সম্পন্ন করার চেষ্টা থাকে সবার। তবে, ওপরের নির্দেশ মেনে নিতেই হবে। গাফিলতির সুযোগ নেই। চাপের মধ্যেও নাগরিক সেবা ঠিক রাখার চেষ্টা করছি বলে জানান ইউএনও।
এবিষয়ে তানোর উপজেলা পরিষদের সদ্য সাবেক নারী ভাইস চেয়ারম্যান সোনীয় সরদার বলেন, তাদের কাছে প্রতিদিন শত শত মানুষ আসতেন বিভিন্ন ধরনের সেবা নেওয়ার জন্য। তবে দায়িত্বে না থাকায় সব কাজের চাপ পড়েছে ইউএনওর ওপর। জনপ্রতিনিধি থাকলে সব দপ্তরের কাজে গতি আসে। মানুষ দ্রুত সেবা পায়। এখন সাধারণ মানুষের সেবা পেতে বিলম্ব এবং হয়রানি হতে হচ্ছে।
সরকারি দায়িত্ব পালনে কোনো অজুহাত চলে না। কাজের চাপ থাকলেও সেবাপ্রত্যাশী কাউকে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে না বলে জানান তানোর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) লিয়াকত সালমান। তিনি বলেন, অফিসের কর্মীদের নিয়ে অতিরিক্ত সময় কাজ করছেন। ৭টি ইউনিয়ন ও দু’টি পৌরসভার এ উপজেলায় দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে যাতে বিলম্বের ফাঁদে না পড়েন, সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে। ই/তা