আস্থাভোটে হেরে দুর্নীতির অভিযোগে মঙ্গোলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশ: ৩ জুন, ২০২৫, ১২:৩৪ পিএম
আস্থাভোটে হেরে দুর্নীতির অভিযোগে মঙ্গোলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ

বিক্ষোভ, রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং আস্থাভোটে ব্যর্থতা—এই তিনের চাপেই পদত্যাগ করলেন মঙ্গোলিয়ার প্রধানমন্ত্রী লুভসান্নামস্রেইন ওয়ুন-এরদেন। উলানবাটরে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা তীব্র জনরোষ, সরকারবিরোধী তরুণদের আন্দোলন এবং দুর্নীতির অভিযোগের মুখে মঙ্গলবার (৩ জুন) তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেন। সংসদে গোপন ব্যালটে আস্থাভোটে পরাজয়ের পর তার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়।

১২৬ আসনের সংসদে আস্থা ভোটে অংশ নেন ৮২ জন আইনপ্রণেতা। এর মধ্যে ওয়ুন-এরদেনের পক্ষে ভোট দেন ৪৪ জন, বিপক্ষে ছিলেন ৩৮ জন। কিন্তু সরকারে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ৬৪ ভোট না পাওয়ায় তিনি সংবিধান অনুযায়ী পদত্যাগে বাধ্য হন। তবে নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত ওয়ুন-এরদেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটরের রাজপথে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে তরুণদের বিক্ষোভ-সমাবেশ চলছিল। মূলত ওয়ুন-এরদেন ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ, অতিরিক্ত বিলাসবহুল জীবনযাপন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা জনমনে ক্ষোভ বাড়িয়ে তোলে। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া প্রধানমন্ত্রীর ছেলের জন্মদিন ও বাগদানের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন এই ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালে।

এই পরিস্থিতিতে ওয়ুন-এরদেনের বিরুদ্ধে আস্থা ভোট আহ্বান করে পার্লামেন্ট। ভোটের ফল ঘোষণার পর তিনি বলেন, ‘মহামারি, যুদ্ধ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপে দেশের জন্য কাজ করতে পারা আমার জন্য সম্মানের ছিল।’ একই সঙ্গে তিনি তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এসব একটি ‘সুপরিকল্পিত অপপ্রচার’। তার কার্যালয় থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতেও বলা হয়েছে, অভিযোগগুলো ‘অপমানজনক ও ভিত্তিহীন’।

তবে আন্তর্জাতিক দুর্নীতি পর্যবেক্ষণ সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। ওয়ুন-এরদেন ২০২১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মঙ্গোলিয়ায় দুর্নীতির পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটে। সংস্থার ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, ১৮০টি দেশের মধ্যে মঙ্গোলিয়ার অবস্থান ছিল ১১৪তম।

মঙ্গোলিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি দুর্নীতির জন্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের ঘটনা। এর আগে ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী সুকবাতার বাটবোল্ডের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অর্থে সম্পত্তি কেনার অভিযোগ উঠেছিল।

মঙ্গোলিয়া বহুদিন ধরে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি এবং খনিজসম্পদ ব্যবস্থাপনায় অব্যবস্থাপনার সঙ্গে লড়ছে। দেশের জনসাধারণের বিশ্বাস, অভিজাতদের একটি অংশ কয়লা খনির মুনাফা আত্মসাৎ করছে, যার ফলে সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।

রাজনৈতিক দিক থেকেও পরিস্থিতি অস্থিতিশীল। ওয়ুন-এরদেনের নেতৃত্বাধীন মঙ্গোলিয়ান পিপলস পার্টি (এমপিপি) গত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর থেকে একটি ত্রিমুখী জোট সরকার দেশ শাসন করে আসছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ডেমোক্রেটিক পার্টির (ডিপি) কিছু তরুণ আইনপ্রণেতা প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগের পক্ষে অবস্থান নিলে এমপিপি ওই দলটিকে জোট থেকে বহিষ্কার করে। এতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও অনিশ্চয়তার দিকে গড়ায়।

সোমবার (২ জুন) সংসদ ভবনের বাইরে শত শত তরুণ বিক্ষোভকারী সাদা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে মিছিল করে। তাদের স্লোগান ছিল—‘পদত্যাগ করা সহজ’। বিক্ষোভের আয়োজক, ২৪ বছর বয়সী উলামসাইখান ওটগন বলেন, ‘এই আন্দোলন প্রমাণ করেছে, তরুণ প্রজন্ম অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার।’

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর গণতন্ত্রের পথে হাঁটলেও মঙ্গোলিয়ায় দুর্নীতি রয়ে গেছে একটি স্থায়ী সমস্যা হিসেবে। রাশিয়া ও চীনের মাঝখানে অবস্থিত এই দেশটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের জন্য ‘তৃতীয় প্রতিবেশী নীতি’ অনুসরণ করে আসছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ওয়ুন-এরদেনের পদত্যাগ শুধু একজন প্রধানমন্ত্রীর বিদায় নয়—এটি মঙ্গোলিয়ার রাজনৈতিক সংস্কার এবং দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। আগামী দিনে কে নতুন প্রধানমন্ত্রী হন এবং তার নেতৃত্বে কী ধরনের সংস্কার আনা হয়, তার ওপরই নির্ভর করবে মঙ্গোলিয়ার ভবিষ্যৎ অভিমুখ।

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW