“বিলাসে রাষ্ট্র আর জনজীবনে অন্ধকার : প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফর নিয়ে কিছু অনিবার্য প্রশ্ন”

মনিরুজ্জামান মনির | প্রকাশ: ১৪ জুন, ২০২৫, ০৮:২৪ পিএম
“বিলাসে রাষ্ট্র আর জনজীবনে অন্ধকার : প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফর নিয়ে কিছু অনিবার্য প্রশ্ন”
মনিরুজ্জামান মনির

একটি প্রশ্ন— এই সফর জনগণের না ব্যক্তির? বাংলাদেশ এখন এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। সাধারণ মানুষ খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা এমনকি ন্যূনতম জীবনধারণের জন্যও প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছে। এই বাস্তবতায় রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত বাস্তবমুখী, সংবেদনশীল ও গণমুখী। কিন্তু যখন আমরা দেখি একজন প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্রীয় খরচে বিলাসবহুল হোটেলে অবস্থান করছেন, একটি রাষ্ট্রীয় ফলপ্রসূ এজেন্ডাবিহীন সফরে লাখো কোটি টাকা ব্যয় করছেন, তখন সেই সিদ্ধান্তকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধ নয়, নৈতিক ও সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও পর্যালোচনা করা জরুরি হয়ে পড়ে।

১. দ্যা ডরচেস্টারে ৩৭ কক্ষ—এটা কি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন? 
৯ জুন ২০২৫, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও তাঁর সফরসঙ্গীরা যুক্তরাজ্যে পৌঁছান এবং লন্ডনের সবচেয়ে ব্যয়বহুল হোটেল দ্যা ডরচেস্টারে চার রাত অবস্থান করেন।

তথ্য অনুযায়ী—
* ৩৭টি রুম রিজার্ভ করা হয়
*  মোট খরচ ২,১০,৩২৫ পাউন্ড, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা (১ পাউন্ড = ১৬৬ টাকা)
* প্রধান উপদেষ্টার রুম প্রতি রাত ৬,০৪৫ পাউন্ড, ৪ রাতের খরচ প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা
এখানে প্রশ্ন—এই ব্যয় কতটা ন্যায়সংগত? কোন রাষ্ট্রীয় লাভের প্রেক্ষিতে এই খরচের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে? কোথায় সেই লাভের প্রমাণ?

২. কোন চুক্তি নয়, শুধু ব্যক্তিগত পুরস্কার এবং রাজনৈতিক সাক্ষাৎ

এই সফরকালে—
* কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়নি
* কোনো রাষ্ট্রীয় সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়নি* বাংলাদেশের কোনো কূটনৈতিক অর্জনের খবর পাওয়া যায়নি বরং জানা গেছে, এই সফরের মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ রাজার কাছ থেকে একটি ব্যক্তিগত পুরস্কার গ্রহণ এবং তারেক রহমানের সঙ্গে ব্যক্তিগত বৈঠক। এখানে প্রশ্ন—এটা কি রাষ্ট্রীয় সফর নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যক্তিগত অনুষ্ঠান?

৩. ফ্ল্যাগ ক্যারিয়ারকে পাশ কাটিয়ে এমিরেটস—রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না ব্যক্তিগত আরাম?
যেখানে বাংলাদেশ বিমানের সরাসরি লন্ডন ফ্লাইট রয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রীয় সফরের অংশ হিসেবে এমিরেটস এয়ারে ফার্স্ট ও বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণ কিসের ইঙ্গিত দেয়?
বাংলাদেশ বিমানের মর্যাদা কী রাষ্ট্রপ্রধানই খাটো করে দেখাবেন? রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব মানেই তো রাষ্ট্রীয় সম্পদের প্রতি দায়বদ্ধতা।

৪. যে সময়ে মানুষ ক্ষুধার্ত, বিদ্যুৎহীন—তখন এই বিলাস কেন?

বাংলাদেশে বর্তমানে—
* লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী পরিবার মহামারীকালীন বিশেষ প্রণোদনা বাতিল হওয়ার ফলে চরম সংকটে
* তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারীরা অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন
* বড় শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংকট, পানির সংকট
* নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৩০%ু৫০% পর্যন্ত

এই বাস্তবতায় যদি একজন নেতা এক রাত ১০ লক্ষ টাকার কক্ষে থাকেন—তাহলে সেটা কাকে প্রতিনিধিত্ব করে? মানুষের রাষ্ট্র, না ব্যক্তির প্রাসাদ?

৫. নৈতিক ও সাংবিধানিক দায় কোথায়?
বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে—
* ৭(১) অনুচ্ছেদ: “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ”
* ২০(১) অনুচ্ছেদ: “রাষ্ট্র জনগণের কল্যাণ সাধনের জন্যে প্রতিষ্ঠিত”

এই সংবিধানের আলোকে প্রশ্ন:
* এই সফরের কতটুকু ছিল জনগণের কল্যাণে?
* এই বিলাসিতা কি জনগণের অর্থে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অপব্যবহার নয়?

৬. যদি সফর ব্যক্তিগত হয়, ব্যয় কেন সরকারি?
একটি পুরস্কার গ্রহণ, রাজনৈতিক ব্যক্তি দেখা করা, এমনকি কিছু বক্তৃতা দেওয়া—সব মিলিয়ে যদি সফর হয় ব্যক্তিগত, তাহলে তার ব্যয় রাষ্ট্র কেন বহন করবে? একজন ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় পদে থাকলেই কি নিজের ব্যক্তিগত কার্যক্রমকে সরকারিভাবে চালাতে পারেন?

৭. এক ভয়ংকর দৃষ্টান্ত: দায়বিহীন রাষ্ট্র পরিচালনা এই সফর কেবল অর্থব্যয়ের নয়, এটি একটি ভবিষ্যৎ দৃষ্টান্ত গড়ছে—
* যেকোনো সময় ব্যক্তি বা গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে
* জনগণের টাকায় ব্যক্তিগত প্রচারাভিযান বা রাজনৈতিক লেনদেন করা যায়
* কেউ যদি জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকে, তাহলে গণতন্ত্র কেবল একটি ফাঁকা কাঠামো হয়ে দাঁড়ায়

৮. জনগণের স্বর কি চুপ থাকবে?
আমরা জানি, বাংলাদেশের মানুষ সবসময় সহনশীল ও কষ্ট সহ্য করতে অভ্যস্ত। কিন্তু এটি কি সেই ধরনের ঘটনা যেখানে নীরবতা মানে সম্মতি হয়ে দাঁড়াবে? আমরা কি সত্যিই এমন রাষ্ট্র চাই—যেখানে জনগণ অনাহারে, অথচ শীর্ষ পর্যায়ে বিলাসিতার প্রতিযোগিতা চলে?

প্রশ্নের সময় এখনই—কারা আসল রাষ্ট্রপ্রধান, জনগণ নাকি অভিজাত শ্রেণি?

বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সংবিধান এবং গণতন্ত্র—সবকিছুই দাঁড়িয়ে আছে জনগণের উপর, কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপর নয়। এই সফরের ঘটনায় সেই গণতন্ত্র যেন একটি অভিজাত মহলের আত্মবিলাসে হারিয়ে যেতে বসেছে। আমরা যদি আজ প্রশ্ন না তুলি, তাহলে কাল আর জিজ্ঞেস করার অধিকারও থাকবে না।

সচেতন নাগরিকদের প্রতি আহ্বান:
* এই ঘটনায় প্রশ্ন তুলুন
* গণমাধ্যমে সত্য প্রকাশে চাপ সৃষ্টি করুন
* সামাজিক মাধ্যমে জনমত তৈরি করুন
* প্রতিটি রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের জবাবদিহিতা দাবি করুন

রাষ্ট্র কার—ব্যক্তির না জনগণের? এই একটি প্রশ্ন আমাদের সময়ের সবচেয়ে জরুরি রাজনৈতিক ও নৈতিক প্রশ্ন। আমরা যদি এর উত্তর না খুঁজি, তবে শুধু অর্থ নয়, আমরা আমাদের গণতন্ত্রও হারাবো।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট