যেভাবে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ভেদ করছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | প্রকাশ: ১৯ জুন, ২০২৫, ০৩:০০ পিএম
যেভাবে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ভেদ করছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র

মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে ইরান-ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি হামলায়। ইসরায়েলের বিমান হামলার জবাবে ইরান সম্প্রতি শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ইসরায়েলের দিকে ছুড়ে দেয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রতিরক্ষা ভেদ করে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে।

মঙ্গলবার (১৮ জুন) ইরান দাবি করে, তাদের হামলায় ইসরায়েলের একটি সামরিক গোয়েন্দা ঘাঁটি ও মোসাদের একটি কেন্দ্র ধ্বংস হয়েছে। অন্যদিকে এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত ইরানে নিহত হয়েছেন প্রায় ২৪০ জন, যাদের মধ্যে ৭০ জন নারী ও শিশু। ইসরায়েলে নিহত হয়েছেন অন্তত ২৪ জন, আহত হয়েছেন শতাধিক।

বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকদের কাছে এ প্রশ্ন এখন কেন্দ্রে—বহুস্তরবিশিষ্ট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অধিকারী ইসরায়েলের আকাশ এত সহজে কিভাবে ভেদ করলো ইরান?

ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই একাধিক স্তরের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে আসছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা:

১. আয়রন ডোম – স্বল্পপাল্লার রকেট ও মর্টার প্রতিরোধে ব্যবহৃত

২. ডেভিড’স স্লিং – মাঝারি থেকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে সক্ষম

৩. বারাক-৮ – মাঝারি পাল্লার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

৪. অ্যারো-২ ও অ্যারো-৩ – দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে ব্যবহৃত

৫. থাড – যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরবরাহপ্রাপ্ত দূরপাল্লার প্রতিরক্ষা সিস্টেম

এই প্রতিটি ব্যবস্থাই রাডার, কন্ট্রোল সেন্টার ও ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার সমন্বয়ে পরিচালিত হয়। প্রতিটি শত্রু ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে অন্তত দুটি ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়। তবে বিশ্লেষকদের মতে, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও সংখ্যাগত চাপে পড়ে এসব ব্যবস্থা এককভাবে কার্যকর থাকতে পারে না।

বিশ্লেষকদের মতে, ইরান কিছু কৌশলগত পদ্ধতির মাধ্যমে ইসরায়েলের শক্ত প্রতিরক্ষা ভেদ করেছে:

১. সংখ্যার ভারে প্রতিরক্ষা ব্যর্থ
ইরান প্রায় ৪০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও অগণিত ড্রোন একযোগে ছুড়েছে। এত বিপুল লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে প্রতিটি ইন্টারসেপ্টরের জন্য দ্বিগুণ ক্ষেপণাস্ত্র খরচ পড়ে, যা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে তাড়াতাড়ি দুর্বল করে।

২. হাইপারসনিক প্রযুক্তি
ইরানের ফাত্তাহ-২ নামের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রে হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল (এইচজিভি) যুক্ত রয়েছে, যা শব্দের গতির চেয়ে পাঁচগুণ বেশি গতিতে ছুটতে পারে এবং অপ্রত্যাশিত গতিপথে চলায় থামানো প্রায় অসম্ভব।

৩. ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের ছদ্মপথ
হোভেইজেহ বা অনুরূপ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিচু উচ্চতায় ধীরে উড়ে, রাডারের চোখ ফাঁকি দিয়ে আঘাত হানতে পারে। দিক পরিবর্তনের ক্ষমতা থাকায় এসব ক্ষেপণাস্ত্রকে থামানো কঠিন।

৪. ডিকয় ও বিভ্রান্তি
ইরান ভুয়া টার্গেট বা ড্রোন পাঠিয়ে ইসরায়েলি রাডার ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিভ্রান্ত করে। ফলে প্রকৃত ক্ষেপণাস্ত্র বাধাবিহীনভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছায়।

৫. রাডার প্রতিরোধী প্রযুক্তি
কিছু ক্ষেপণাস্ত্র রাডার-বিধ্বংসী প্রযুক্তি ব্যবহার করে, ফলে সেগুলো রাডারে ধরা পড়ে না।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, শনিবারের হামলায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ৮০-৯০ শতাংশ কার্যকর ছিল। অর্থাৎ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করা গেলেও অনেকগুলো আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে।

তেলআবিবের সামরিক সদর দপ্তর ‘কিরিয়া’-তেও ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানায় ইসরায়েলের জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সাইরেন শুনে মানুষজন নিয়মিত আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধে এখন মূল প্রশ্ন—কে কতদিন অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা ছাড়া ইসরায়েলের পক্ষে এই দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে আধিপত্য বজায় রাখা কঠিন হতে পারে।

এই সংঘাতের গতি-প্রকৃতি এখন নির্ভর করছে দুই দেশের অস্ত্র মজুতের ওপর। ইরান কতদিন ধরে একযোগে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে পারবে, আর ইসরায়েল কতদিন ধরে প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে পারবে—এই প্রতিযোগিতা এখন যুদ্ধের মূল ব্যাকরণ হয়ে উঠেছে।