বাংলাদেশে গুমের শিকার ব্যক্তিদের অন্তর্নিহিত চিত্র উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি জানিয়েছে গঠিত তদন্ত কমিশন। বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) রাজধানীর গুলশানে কমিশনের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গুম সংক্রান্ত কমিশন অফ ইনকোয়ারির সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী জানান, গুমের শিকারদের অন্তত চার ধরনের পরিণতি হয়েছে—যা দেশব্যাপী একটি পদ্ধতিগত রাজনৈতিক দমননীতির সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে।
কমিশনপ্রধান মইনুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন অভিযোগ ও সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে চারটি সম্ভাব্য পরিণতি চিহ্নিত করা হয়েছে:
১. গোপনে হত্যাকাণ্ড।
২. ‘জঙ্গি’ তকমা দিয়ে গণমাধ্যমে হাজির করে বিচারাধীন বা নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো।
৩. সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে সে দেশের বাহিনীর মাধ্যমে গ্রেপ্তার করানো।
৪. অল্প কিছু ক্ষেত্রে মামলা না দিয়ে মুক্তি দেওয়া।
তিনি বলেন, এ ঘটনা কেবল বিচ্ছিন্ন কিছু নিরাপত্তা কর্মীর অপতৎপরতা নয়; বরং এটি ছিল একটি সংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অধীনে পরিচালিত রাজনৈতিক দমনপ্রক্রিয়া। কমিশনের তথ্য অনুসারে, গুমের শিকারদের মধ্যে ছিলেন ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও সাধারণ নাগরিক।
গুম সংক্রান্ত দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে প্রায় ১ হাজার ৮৫০ অভিযোগ বিশ্লেষণ করে ২৫৩ জন গুমের শিকার ব্যক্তির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই সেই সময়কার বিরোধী মতাদর্শের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। রিপোর্টে বলা হয়েছে, গুমের মুহূর্ত থেকে ফিরে আসার সময় পর্যন্ত তাদের অভিজ্ঞতা আশ্চর্যজনকভাবে মিল রয়েছে—প্রক্রিয়া, নির্যাতনের ধরণ, অভিযোগের ভাষা—সবই প্রায় একরকম।
কমিশনের বক্তব্য অনুযায়ী, এই ঘটনাগুলো কোনো কাকতালীয় বিষয় নয়, বরং একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দমন যন্ত্রের পরিকল্পিত প্রয়োগ। এসব গুমের নেপথ্যে ইসলামি উগ্রবাদের হুমকিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ক্ষমতা সংহত করা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন এবং শাসন দীর্ঘায়িত করার প্রচেষ্টা ছিল বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।
কমিশন জানায়, গোপন আটক কেন্দ্রের অস্তিত্ব এখন আর অস্বীকারযোগ্য নয়। অনেক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, তারা সেসব কেন্দ্রে আটক থাকাকালীন একে অপরকে দেখেছেন এবং একই ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কমিশনের তথ্যে দেখা যায়, যাদের গুম করা হয়েছিল তাদের ৮১ শতাংশ জীবিত অবস্থায় ফিরে এলেও ১৯ শতাংশ এখনও নিখোঁজ। এদের মধ্যে ১২ জন ভুক্তভোগী সম্পর্কে প্রাথমিক অনুসন্ধানে কারা দায়ী তা শনাক্ত করা গেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি।
কমিশনের অনুসন্ধানে বিলম্বের অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়েছে—পুরনো কললিস্ট পাওয়া না যাওয়া, তথ্যের ঘাটতি ও প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগিতা।
কমিশনের প্রতিবেদনে দুটি সুপারিশ করা হয়েছে:
১. সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহার রোধে এবং ন্যায়বিচারের মানদণ্ডে মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি।
২. বর্তমান ‘কাউন্টার টেররিজম’ পদ্ধতির পরিবর্তে মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার মতো মানবাধিকারবান্ধব মডেল অনুসরণ।
কমিশনপ্রধান বিচারপতি মইনুল ইসলাম বলেন, “সন্ত্রাসবাদ একটি বাস্তব হুমকি। কিন্তু এই হুমকি দমনে রাষ্ট্র যদি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে আইন ব্যবহার করে, তাহলে গণতন্ত্র, প্রতিষ্ঠান ও জনগণের আস্থার উপর তা মারাত্মক আঘাত হানে।”
গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর গঠিত এই কমিশন ইতোমধ্যে সারা দেশে ১৬টি গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন করেছে এবং ১৩১টি অভিযোগ পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে অনুসন্ধানের জন্য পাঠিয়েছে। কমিশনের সদস্যদের মতে, অনুসন্ধান প্রক্রিয়া জটিল হলেও তা অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে চলছে।
সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের সদস্য মোঃ ফরিদ আহমেদ শিবলী, নূর খান, নাবিলা ইদ্রিস ও সাজ্জাদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।