মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার আবহে শনিবার (২১ জুন) ভোরে যুক্তরাষ্ট্র বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান দিয়ে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এই হামলার মধ্য দিয়ে জোরালো হচ্ছে সেই পুরোনো প্রশ্ন—যুক্তরাষ্ট্র কি আবারও ইরাক যুদ্ধের মতো এক 'ভয়াবহ ভুল' করতে চলেছে? এবার লক্ষ্যবস্তু ইরান।
ইরাকের ছকে ইরান?
দুই দশক আগে ২০০৩ সালে ইরাকে হামলার পূর্বপ্রস্তুতিতে ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্র’ থাকার অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা মিত্ররা আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলে। পরে দেখা যায়, সে অভিযোগ মিথ্যা ছিল। আজও ইরাক সেই যুদ্ধের ভয়াবহ ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
একই ছক কি এবার ইরানের ক্ষেত্রেও অনুসৃত হচ্ছে? বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বক্তব্য এবং পদক্ষেপে সেই আশঙ্কাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ
ইরান ১৯৬৮ সালে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে (NPT) সই করে এবং ১৯৭০ সালে তা অনুমোদন করে। এরপর থেকে দেশটি নিজেকে পারমাণবিক অস্ত্রহীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং বলে আসছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি গবেষণা ও শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। তদ্ব্যতীত, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA) নিয়মিত তেহরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করে আসছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েল এনপিটিতে সই করেনি, আবার মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবেও পরিচিত। তারা আইএইএকে কোনো পরিদর্শনের সুযোগ দেয়নি। সেই ইসরায়েলই ২০২৫ সালে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে উত্তেজনার সূচনা করে এবং যুক্তরাষ্ট্র সেখানে সরাসরি অংশগ্রহণ করে।
পরমাণু সক্ষমতা: বিভ্রান্তিকর তথ্যপুঞ্জ
ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ দাবি করেছে, ইরান ১৫ দিনের মধ্যেই পরমাণু বোমা বানাতে সক্ষম। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, এর জন্য ইরানের কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে। এমন অসংগত দাবির প্রেক্ষিতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন স্পষ্টভাবে বলেছেন, ইরান পরমাণু বোমা তৈরি করতে চায় না। একই কথা বলেছিলেন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড, যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই বক্তব্য ‘ভুল’ বলে উড়িয়ে দেন।
অতীতের অভিজ্ঞতা: ইরাক ধ্বংস, দায় স্বীকার
যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের নেতৃত্বে ইরাকে সামরিক অভিযান শুরু করে। সেসময় দাবি করা হয়েছিল, ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে। কিন্তু সেই অস্ত্র পাওয়া যায়নি। ইরাকের হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতা ও রাজধানী বাগদাদ ধ্বংস হয়, লাখো মানুষ নিহত ও বাস্তুচ্যুত হয়। ২০১১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শেষ হলেও, এর রেশ এখনো চলছে। দ্য গার্ডিয়ান-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে ‘ভুল’ করেছিল। এবার কি ইরানেও তাই ঘটবে?
পার্থক্য কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানকে ‘নতুন ইরাক’ ভাবা বড় ভুল হবে। ইরান কেবল রাজনৈতিকভাবে নয়, সামরিক ও কূটনৈতিকভাবেও অনেক বেশি সংগঠিত ও প্রস্তুত একটি রাষ্ট্র। ২০১৫ সালে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি সীমিত রাখে। সেই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে বের হয়ে আসে এবং এরপর থেকে ইরানের ওপর চাপ বাড়াতে থাকে।
ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় দফায় এই চাপের মাত্রা আরও বাড়ে। আলোচনার পঞ্চম দফার মধ্যেই ইসরায়েল ইরানে হামলা চালায়। এরপর ইরান-ইসরায়েল সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে এবং তারই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি হামলা চালায়।
যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ইরানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ হামলা শুধু পারমাণবিক অবকাঠামোর বিরুদ্ধে নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের সূচনাও হতে পারে। ইরাকে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি এখনো বিদ্যমান, এমনকি মাঝেমধ্যে সেখানে হামলার খবরও আসে। একই রকম পরিস্থিতি যদি ইরানে শুরু হয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্য আরও একটি দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মুখোমুখি হবে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণ বলছে, ইরানিদের বড় অংশ সরকারবিরোধী হলেও তারা বিদেশি হামলার বিরোধী এবং এ ধরনের আগ্রাসনে জাতীয় ঐক্য ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। ফলত যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের জন্য এই যুদ্ধ সহজ হবে না।