কিশোর তোফাজ্জল হোসেনের বয়স ১৪ বছর । ৫ম শ্রেণী লেখাপড়া করার পর আর বিদ্যালয়ে যাওয়া তার ভাগ্যে সেই সুযাগ হয়নি। পাঠশালা শেষ করেই তাকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। চার সদস্যর পরিবারের ভরন- পোষনের একমাত্র ভরসা হলো কিশোর তোফাজ্জলের আয়ের উপর নির্ভর করে পরিবারের সবাইকে বেঁচে থাকা।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী ৯নং ইসলামপুর ইউনিয়নের কাঁঠালকান্দি গ্রামের আহমেদ আলীর (৬৫) ১ মেয়ে আয়েসা খাতুন (২৫) ও ১ ছেলে তোফাজ্জল হোসেন (১৪) এবং বৃদ্ধ মা সমিতা বিবি (৮২) (তোফাজ্জল হোসেনের দাদী)। প্রায় তিন বছর পূর্বে তোফাজ্জলের মা মারা যান। তোফাজ্জলের বৃদ্ধ বাবা হার্টের রোগে আক্রান্ত হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। তার একমাত্র বোন আয়েসা খাতুন ও মানসিক ভারসাম্যহীন। আর বয়োবৃদ্ধা দাদী সমিতা বিবি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী।
তোফাজ্জলের একটি পুরনো বাইসাইকেল হলো তার একমাত্র সম্পদ ও আয়ের ভরসা । প্রতিদিন সকালে বাইসাইকেল চালিয়ে ১৫ কিলোমিটার দুরের দূর্গম খাসিয়া পল্লীতে সারাদিন কাজ করে আড়াই শত টাকা রোজগার করে। এই সামান্যে টাকা দিয়ে ডাল ভাত খেয়ে না খেয়ে কোন ভাবে বেঁচে থাকতে হয়।
কিশোর তোফাজ্জলের সাথে আলাপ কালে কান্নাজড়িত কন্ঠে জানায়, মা আমাদের ছেড়ে এ দুনিয়া থেকে চিরদিনের জন্য চলে গেছেন। এছাড়া পরিবারের চার জনের মধ্যে বাবা, দাদী, ও বোন সবাই অসুস্থ। একা আামাকেই সংসার চালাতে হয়। প্রতিদিন সকালে ভাঙাচোরা একটি বাইসাইকেল নিয়ে ১৫ কিলোমিটার দুরের খাসিয়া পল্লীতে কাজে যাই। সেখান থেকে সন্ধ্যায় বাড়ীতে ফিরি। যা রোজগার হয়, দু'বেলাও খেতে পাইনা। এ দুনিয়ায় আল্লাহ ছাড়া আমাদের আর কেউ নাই।
তোফাজ্জলের প্রতিবেশী মো: ফজল মিয়া, আবু শহীদ এ পরিবারের দুরাবস্থার কথা জানিয়ে বলেন, প্রকৃতই তারা খুব অসহায় ও মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। চার জনের পরিবারের তিন জনই অসুস্থ। মাঝে মধ্যে আমরা যতটা সম্ভব সহযোগিতা করার চেষ্টা করি।
সরেজমিন তোফাজ্জলদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সরকারি আবাসন প্রকল্পের ছোট্ট একটি ঘরে মেঝের জীর্ণ কাঁথায় শুয়ে আছেন সমিতা বিবি। অপুষ্টি আর ক্ষুধার যন্ত্রণায় ক্লান্ত। ঠিকমতো কথা বলতে পারছেন না। যা বললেন বোঝা গেলো, ঈদের দিন ডালভাত খেয়ে দিন পার করেছি। ক্ষিদের জ্বালায় রাতে ঘুম আসে না। এক রত্তি নাতি আর কিইবা করবে। তবু যা করছে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। চাউল ডাইল আনলে ঔষধ আনতে পারে না। তবু প্রায়ই অনাহারে থাকতে হয়। ঈদে চাঁন্দে প্রতিবেশীরা কেউ খাবার দেয়, কেউ সামান্য টাকা-পয়সা দেয়। এইভাবেই টিকে আছি। স্থানীয়দের সহযোগিতাই একমাত্র ভরসা। মানুষের সাহায্যে দুমুঠো ভাত খেতে পারেন, যদি কেউ সাহায্যে না করে তাহলে না খেয়েই থাকতে হয়। তার বিলাপে চোখে জল চলে আসে। এ যেন দারিদ্র্যের এক করুণ চিত্র। এই অসহায় নারীর জীবন কাটছে অভাব আর কষ্টে। পা ভেঙে এক বছর ধরে শয্যাশায়ী। ছেলে আলী আহমেদ ও হার্টের রোগী। কোন কাজ কর্ম করতে পারেন না। নাতনীও মানসিক ভারসাম্যহীন। তাই ১৩/১৪ বছরের নাতি তোফাজ্জলের কাঁধেই সংসারের ভার। দুর্গম খাসিয়া পুঞ্জিতে কাজ করে দিনে আয় করে দুই-আড়াইশো টাকা মাত্র। এ টাকায় দু’'বেলা খাবার যোগানোই মুশকিল। তার উপর অসুস্থ দাদী, বাবা আর মরার উপর খাঁড়ার ঘা মানসিক প্রতিবন্ধী বড় বোন আয়েশা খাতুন।
ইসলামপুর ইউনিয়নের স্থানীয় ইউপি সদস্য ফারুক আহমেদ জানান, একসময় তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিলো না। কয়েক বছর আগে সরকারি আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে এ পরিবারের জন্য একটি ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোফাজ্জলদের দুরাবস্থা জেনে অনেকে খাদ্য সামগ্রী দিয়ে তাদেরকে সহায়তা করছেন। তবে বয়োবৃদ্ধ সমিতা বিবি ও মানসিক প্রতিবন্ধী আয়েশা খাতুনের সুচিকিৎসা ও তোফাজ্জলদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার ব্যবস্থা জরুরী।