জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিলুপ্তি-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত ঘিরে রাজস্ব খাতে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা আরও গভীর হয়ে পড়ছে। আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনমনীয় অবস্থান, অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল এবং সরকারের হুঁশিয়ারির মধ্যে পরিস্থিতি নতুন মোড় নিচ্ছে। দেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্যে এই অচলাবস্থা ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট মহল।
রোববার (২৯ জুন) অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেন অনতিবিলম্বে কর্মস্থলে ফিরে আসেন এবং আইনবিরোধী ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসেন। অন্যথায় দেশের জনগণ ও অর্থনীতির সুরক্ষায় সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে।
সরকারের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের বাজেট ব্যবস্থাপনায় উন্নয়নমুখী কার্যক্রম পরিচালনার বড় সীমাবদ্ধতা দুর্বল রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের প্রয়োজনের তুলনায় রাজস্ব আহরণ অনেক কম হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার নানাবিধ দুর্বলতা, অনিয়ম ও দুর্নীতি। এই প্রেক্ষাপটে সকল অংশীজনের পরামর্শে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সরকার উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছে, কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী গত দুই মাস ধরে নজিরবিহীনভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি এবং রাজস্ব আদায় কার্যক্রম ব্যাহত করছেন। আন্দোলনের নামে চরম দুর্ভোগ তৈরি হয়েছে, যা সরকারের মতে পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, আন্দোলনকারীরা শুধুমাত্র সংস্কারের বিরোধিতা করছেন না, বরং অর্থ বছরের শেষ দুই মাসে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছেন। সরকার মনে করছে, এই আন্দোলন পরিকল্পিত এবং জাতীয় স্বার্থ ও নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী।
সরকারের পক্ষ থেকে রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি বিবেচনার আশ্বাস দেওয়া হলেও আন্দোলনকারীরা আলোচনায় বসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। বরং তাঁরা অনমনীয় অবস্থানে থেকে দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করে চলেছেন।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জাতীয় স্বার্থে অতি জরুরি আমদানি-রপ্তানি এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের কার্যক্রম চালু রাখতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন সব কাস্টমস হাউস, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট এবং শুল্ক স্টেশনের সব শ্রেণির চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় সেবা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
অন্যদিকে আন্দোলনরত কর্মকর্তারা দাবি করছেন, এনবিআর বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত তাঁদের স্বার্থের পরিপন্থী এবং এটি বাস্তবায়ন হলে রাজস্ব খাতে ভয়াবহ সংকট তৈরি হবে। তাঁরা এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণসহ বিভিন্ন দাবিতে অনড় রয়েছেন।
অচলাবস্থার প্রভাবে রাজস্ব আহরণ কার্যত বন্ধ হয়ে পড়েছে। এর ফলে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমও থমকে আছে। দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী, এই অচলাবস্থা প্রতিদিন হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য ক্ষতির কারণ হচ্ছে। বিজিএমইএ থেকে শুরু করে বিসিআই, এমসিসিআই—সবাই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, দীর্ঘমেয়াদি এই অচলাবস্থা ব্যবসা-বাণিজ্যকে ভয়াবহ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ রোববার (২৯ জুন) অর্থ মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, কর্মকর্তারা শাটডাউন চালিয়ে যেতে চাইলে সেটা তাঁদের সিদ্ধান্ত, তবে শাটডাউন চলাকালীন কোনো আলোচনা হবে না। অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্যের পরপরই আন্দোলনকারীরা বৈঠক বাতিলের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং শাটডাউন স্থগিত না করে আলোচনায় না বসার ঘোষণা দিয়েছেন।
চলমান অচলাবস্থায় এনবিআরের কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। দেশের বন্দরগুলোতে পণ্য আটকে আছে, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স বন্ধ রয়েছে। ব্যবসায়ী মহল যেমন ক্ষতির হিসাব দিচ্ছে, তেমনি সরকারের পক্ষ থেকেও পরিস্থিতি সামাল দিতে কঠোর অবস্থান নেওয়ার আভাস মিলছে।
অর্থনীতি, রাজস্ব এবং বৈদেশিক বাণিজ্যকে ঘিরে এই অচলাবস্থা কোন দিকে মোড় নেয়, সেটি নিয়ে সারা দেশে গভীর উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।