ইরানের নিখোঁজ ইউরেনিয়াম ঘিরে রহস্য, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উদ্বেগ

এফএনএস আন্তর্জাতিক ডেস্ক: | প্রকাশ: ৩০ জুন, ২০২৫, ০৬:১৯ পিএম
ইরানের নিখোঁজ ইউরেনিয়াম ঘিরে রহস্য, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উদ্বেগ

মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত ভূরাজনীতির নতুন কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি। রোববার ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ বিমান হামলার পর থেকেই শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা প্রশ্ন আর উদ্বেগ। বিশেষ করে ফোরদো, নাতাঞ্জ এবং ইসফাহান-এই তিনটি স্থাপনায় চালানো হামলার প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি এবং সেখানে মজুত থাকা উন্নতমানের ইউরেনিয়ামের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে রহস্যের ঘনঘটা।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, এসব স্থাপনায় বাংকার বাস্টার বোমার মাধ্যমে ‘সম্পূর্ণ ধ্বংস’ ঘটানো হয়েছে। তবে জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থা আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) সেই দাবিকে এখনই নিশ্চিত করতে পারছে না। সংস্থাটির মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি সোমবার জানিয়েছেন, বিশেষ করে পাহাড়ের গভীরে অবস্থিত ফোরদো প্ল্যান্টে কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। ফোরদোই ছিল ইরানের সর্বোচ্চমাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কেন্দ্র।

আইএইএর হিসাব অনুযায়ী, ইরানের হাতে প্রায় নয় টন সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৪০০ কেজি ইউরেনিয়াম ৬০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ। এই মাত্রাকে ৯০ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব হলে অন্তত নয়টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করা যেত। ফলে এই ইউরেনিয়ামের প্রকৃত অবস্থা বা ‘নিখোঁজ’ হওয়ার শঙ্কা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পশ্চিমা কূটনৈতিক সূত্রগুলো রয়টার্সকে জানিয়েছে, ইরানের উপর হামলার কয়েক দিন আগেই ফোরদো থেকে বেশির ভাগ ইউরেনিয়াম সরিয়ে ফেলা হতে পারে। এমন মন্তব্য করেছেন একাধিক পশ্চিমা কর্মকর্তা। স্যাটেলাইট চিত্রেও ফোরদোর বাইরে ট্রাকসহ একাধিক যানবাহনের অস্বাভাবিক গতিবিধির ইঙ্গিত মিলেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিট হেগসেথ বৃহস্পতিবার বলেছেন, ইরান ইউরেনিয়াম সরিয়ে ফেলেছে-এমন গোয়েন্দা তথ্য তার কাছে নেই। ট্রাম্পও এই দাবি নাকচ করে ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “ওরা কিছুই সরায়নি। ওগুলো খুব ভারী, সরানো খুব কঠিন। আর আমরা হঠাৎ করেই হামলা করেছি, তারা জানতেই পারেনি।”

আইএইএর সাবেক শীর্ষ পরিদর্শক ওলি হেইনোন রয়টার্সকে বলেন, “ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন থেকে নমুনা সংগ্রহ, ফরেনসিক বিশ্লেষণ এবং পরিবেশগত পরীক্ষা করতে অনেক সময় লাগবে। ধ্বংসাবশেষের নিচে অনেক উপাদান চাপা পড়ে থাকতে পারে, আবার কিছু হয়তো পুরোপুরি হারিয়েও গেছে।”

এরই মধ্যে ইরান হুঁশিয়ারি দিয়েছে, তারা আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করতে পারে। দেশটির পার্লামেন্ট সম্প্রতি এক প্রস্তাব পাস করেছে, যাতে বলা হয়েছে, আইএইএর সাম্প্রতিক এক প্রস্তাবই ইসরায়েলের বিমান হামলার জন্য কূটনৈতিক আচ্ছাদন তৈরি করেছে। তেহরান বলছে, আইএইএর ৩৫ সদস্যবিশিষ্ট বোর্ড ইরানকে পরমাণু চুক্তি লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করে যে প্রস্তাব পাস করেছে, তার পরদিনই ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে। তবে আইএইএ এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।

ইরান দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও জানিয়েছে, ইরান যে পারমাণবিক বোমা তৈরির কর্মসূচি চালাচ্ছে-তার কোনও কার্যকর প্রমাণ তাদের কাছে নেই। তবে বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলছেন, ৬০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার যৌক্তিকতা নিয়ে। কারণ, বেসামরিক পরমাণু চুল্লি পরিচালনায় ৫ শতাংশেরও কম ইউরেনিয়াম যথেষ্ট।

আইএইএ জানিয়েছে, ইরান তাদের মজুদের হিসাব দিতে বাধ্য এবং সংস্থাটি তা যাচাই করে পরিদর্শনসহ বিভিন্ন উপায়ে। তবে আইএইএর ক্ষমতা সীমিত। তারা কেবল ঘোষিত পরমাণু স্থাপনাগুলোতেই পরিদর্শন করতে পারে, গোপন স্থাপনায় হঠাৎ ঢ়ুকতে পারে না। আর এই সীমাবদ্ধতাই ইরানকে সম্ভাব্য ‘চোর-পুলিশের খেলা’ খেলার সুযোগ করে দেয়।

ওয়াশিংটনভিত্তিক আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের বিশ্লেষক কেলসি ড্যাভেনপোর্ট শুক্রবার এক্স-এ লিখেছেন, “৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম হয়তো হামলার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল না, কিন্তু এখন তা বিস্তার-ঝুঁকির অন্যতম প্রধান উপাদান, বিশেষত যদি সেন্ট্রিফিউজগুলো হিসাববহির্ভূত থাকে।”

ইরাকের প্রেক্ষাপট টেনে পশ্চিমা এক কূটনীতিক বলেছেন, “২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের আগে জাতিসংঘের পরিদর্শকরা গণবিধ্বংসী অস্ত্রের খোঁজে ব্যর্থ হয়েছিল। এবারও সেই ধরনের অনিশ্চয়তার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। যদি ইরান তাদের ৪০০ কেজি উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের ব্যাপারে স্বচ্ছ না হয়, তাহলে কেউই নিশ্চিত হতে পারবে না, আসলে কী ঘটেছে।”

আইএইএ মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি বুধবার বলেছেন, “এসব স্থানে এখন অনেক ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে, এমনকি অবিস্ফোরিত বোমাও থাকতে পারে। এই অবস্থায় আমাদের পরিদর্শকদের জন্য কাজ করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে।”

এ অবস্থায়, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি, ইউরেনিয়ামের প্রকৃত মজুদ এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি ঘিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে দানা বাঁধছে উদ্বেগ।