কাপাসিয়ায় গণপিটুনিতে নিহতের ঘটনায় মামলা, আটকরা জয়বাংলা শ্লোগান দিচ্ছে

এফ এম কামাল হোসেন; কাপাসিয়া, গাজীপুর | প্রকাশ: ৪ জুলাই, ২০২৫, ১২:০৪ পিএম
কাপাসিয়ায় গণপিটুনিতে নিহতের ঘটনায় মামলা, আটকরা জয়বাংলা শ্লোগান দিচ্ছে
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার কড়িহাতা ইউনিয়নের বেহাইদুয়ার গ্রামের মাদকসেবী ও সন্ত্রাসী মোঃ নাঈমকে (২৪) পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। ২ জুলাই বুধবার রাতে নিহতের মাতা মমতাজ বেগম বাদী হয়ে ১৩ জনের নাম উল্লেখ করেন এবং অজ্ঞাতনামা আরো ১০/১২ জনকে আসামি করা হয়। আটককৃত ২ জনকে আদালতে পাঠানোর জন্য প্রিজন ভ্যানে উঠানোর সময় তারা জয়বাংলা স্লোগান দিতে থাকে। এর আগে গত মঙ্গলবার সকাল সাড়ে দশটার দিকে পূর্ব শত্রুতার জেরে প্রতিপক্ষের কিছু লোকজন নিহত নাঈমকে পার্শ্ববর্তী মনোহরদী উপজেলার দৌলতপুর এলাকার তার নানার বাড়ি থেকে নিজ এলাকায় নিয়ে আসে। তার অত্যাচারে অতীষ্ট লোকজন উত্তেজিত হয়ে গণপিটুনি দেয়। ফলে ঘটনাস্থলেই সে মারা যায় সে ওই গ্রামের মাদক বিক্রেতা মোঃ নাজিম উদ্দিনের ছেলে। জানাযায়, এলাকার কুখ্যাত ত্রাস নামে খ্যাত নাঈমের বিরুদ্ধে নানা অপকর্মের দায়ে কাপাসিয়া থানায় ৮ টি মামলা রয়েছে। ইতিপূর্বে সে মারামারি, দাঙ্গা হাঙ্গামা, চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ, দখল, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ সহ নানাবিধ অভিযোগ রয়েছে। ঘটনাস্থলটি উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় এবং নিহত নাঈম সংঘবদ্ধ হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার কোন সাহস পেতো না। ওই এলাকার একাধিক ভুক্তভোগী স্বস্তি প্রকাশ করে বলেন, দীর্ঘদিন যাবত নাঈম তার বাহিনী নিয়ে এলাকার নিরিহ লোকজনদের ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে সুবিধা আদায় করতো। চাহিদা মতো তার কথা না শুনলে অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যেতো। নিহত নাঈমের প্রতিবেশি চাচী এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রধান আসামি সোহেল রানার মা ফেরদৌসি বেগম জানান, প্রায় দুই মাস আগে গভীর রাতে তার ছেলে সোহেল রানা (৩৫) স্থানীয় আড়াল বাজার থেকে বাড়ি ফিরার পথে মোঃ নাঈম ও তার ভাই মোঃ কাইয়ুম কিছু টাকা দাবি করলে তা না দেওয়ায় তাকে এলোপাথারি কুপিয়ে রাস্তার পাশে ফেলে রাখে। পরে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে রেফার করেন। এ ঘটনায় তার মেয়ে রুমানা সানী একটি মামলা করলে নাঈমের পরিবারের সদস্যরা পলাতক রয়েছে। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর গত রোববার সোহেল বাড়ি ফিরলে মঙ্গলবার দুপুরে নাঈম একটি চাপাতি নিয়ে সোহেলের বাড়িতে গিয়ে তাকে হত্যার হুমকি দেয়। এ সময় সে ঘরের দরজা বন্ধ করে আশপাশের লোকজন ও স্বজনদের ফোন দিয়ে বিষয়টি জানায়। পরে স্থানীয় শতাধিক লোক নাঈমকে ঘেরাও করে গণপিটুনি দেয়। এক পর্যায়ে সে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। ঘটনাস্থলের পাশ্ববর্তী মুদি দোকানী মোঃ রবিউল জানান, নাঈম ও তার ভাই কাইয়ুম এলাকার চিহ্নিত মাদক কারবারি। তারা প্রায় রাতেই এলাকার বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে মোবাইল ফোন ও টাকা পয়সা ছিনতাই করত। তাছাড়া যে কোন বিষয়ে ঝামেলা হলেই তারা দা, ছুরি ও চাপাতি দিয়ে লোকজনকে কুপিয়ে আহত করত। একই গ্রামের সৌদি প্রবাসী মোঃ আল আমীন জানান, প্রায় এক বছর আগে তিনি ছুটিতে দেশে আসলে নাঈম তার এনড্রয়েড মোবাইল ফোনটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। বহু দেন দরবার করেও তা উদ্ধার করতে তিনি ব্যর্থ হন। ওই গ্রামের আসাদ শেখ জানান, নাঈম ও তার ভাই কাইয়ুম বহু মানুষকে বাড়িতে এনে জিম্মি করে টাকা আদায় করতো। তাদের নামে কাপাসিয়া ও আশপাশের বিভিন্ন থানায় বহু মামলা চলমান রয়েছে। তাই এলাকার লোকজন তাদের অত্যাচারে অতীষ্ট হয়ে গণপিটুনি দিয়ে নাঈমকে হত্যা করেছে। মামলার বিবরণে জানা যায়, পার্শ্ববর্তী মনোহরদী উপজেলার কোচের চর গ্রামের নাঈমের নানার বাড়ি থেকে গত মঙ্গলবার সকাল ১০:৩০ টার সময় উল্লেখিত ১৩ জন আসামি সহ আরো ১০/১২ অজ্ঞাতনামা সিএনজি যোগে তাকে ধরে নিয়ে আসে। একঘন্টা পর তার মা মমতাজ বেগম জানতে পারেন তার ছেলে নাঈমকে বেহাইদুয়ার গ্রামের জনৈক বাতেন মিয়ার পরিত্যাক্ত বাড়িতে এনে চাপাতি লাঠিসোটা, লোহার রড দিয়ে কোরাইয়া, বাইরাইয়া মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর রক্তাক্ত জখম করে। পরে খবর পেয়ে থানা পুলিশ জনৈক রমিজ উদ্দিনের ফাঁকা জমি থেকে নাঈমকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে। নিহত নাঈমের মা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে জানতে পারেন বেহায়দুয়ার গ্রামের সোবহানের পুত্র সোহেল (৩৫), আফাজ উদ্দিনের পুত্র জামাল (৩০), আনোয়ার (২৭), কালামের পুত্র হুমায়ূন (২৫), মোমেন (২২), কাজলের পুত্র ফরহাদ (৩৫), টুকু মিয়ার পুত্র বাদল (৩৫), মাসুদ (৩০), জালু মিয়ার পুত্র সাইফুল (৩৫), আতাবুদ্দিনের পুত্র মহিউদ্দিন (৪০), সোহেল (২৫), সোবহানের স্ত্রী মতি বেগম (৪৮) এবং রশিদ (২২) সহ অজ্ঞাতনামা আরো ১০/১২ জন মিলে তাকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করে এবং মৃত অবস্থায় রমিজ উদ্দিন বেপারীর জমিতে ফাঁকা জায়গায় ফেলে রেখে চলে যায়। এ বিষয়ে কাপাসিয়া থানার ওসি জয়নাল আবেদীন মন্ডল জানান, উপজেলার বেহায়দুয়ার গ্রামের নাঈম হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত বাদল ও মাসুদ এবং সন্দেহভাজন সিরাজ, সুমন ও শামসুলকে আটক করে বৃহস্পতিবার দুপুরে আদালতে পাঠানো হয়েছে। অন্যান্যদের গ্রেফতারে পুলিশ যথেষ্ট তৎপর রয়েছে। এদিকে মঙ্গলবার সকালে এলাকাবাসী নাঈমকে গণপিটুনি দিয়ে নিহত হওয়ার পর পরই তার মা মমতাজ বেগম একটি ভিডিও ফুটেজে বিএনপি দলীয় নেতাদের এ ঘটনার সাথে জড়িয়ে বক্তব্য দেন। অথচ প্রথম আরেকটা ভিডিওতে এলাকার ৪ জনের নাম উল্লেখ করে বক্তব্য দেন। পরবর্তীতে একটি কুচক্রী মহলের প্ররোচনায় মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যমূলক ভাবে বিএনপি নেতাদের নামে মিথ্যা অভিযোগ করেন বলে দলীয় আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে দাবি করেন। তারা বলেন, দীর্ঘদিন যাবত নিহত নাঈমের দ্বারা যা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারাই উত্তেজিত হয়ে তাকে গণপিটুনি দেন। এঘটনার সাথে বিএনপির লোকজন কোনভাবেই জড়িত নয়। গাজীপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও কাপাসিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি শাহ্ রিয়াজুল হান্নান বুধবার দুপুরে গাজীপুর প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য দেন। গুজব না ছড়িয়ে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করতে উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রতি বিশেষ ভাবে অনুরোধ জানান।
আপনার জেলার সংবাদ পড়তে