যশোর শিক্ষাবোর্ডের নির্দেশনা লংঘন করে

ফুলতলায় শিক্ষক সমিতির ভুলে ভরা প্রশ্নপত্রেও বাণিজ্য

এফএনএস (শামসুল আলম খোকন; ফুলতলা, খুলনা) : | প্রকাশ: ৯ জুলাই, ২০২৫, ০৮:২০ পিএম
ফুলতলায় শিক্ষক সমিতির ভুলে ভরা প্রশ্নপত্রেও বাণিজ্য

যশোর শিক্ষাবোর্ডের নির্দেশনা লংঘন করে মাধ্যমিক স্কুলের অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে খুলনার ফুলতলা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির বিরুদ্ধে। শিক্ষক সমিতির সিডিউল অনুযায়ী অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরীক্ষা গ্রহণ না করে তাদের সুবিধামত সময়ে ও ভুলে ভরা প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা গ্রহণ করায় উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকবৃন্দ। আর পরীক্ষার সিডিউল ভঙ্গের অভিযোগ খোদ সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে শিক্ষাবোর্ড বিদ্যালয় পরিদর্শক জানিয়েছেন।  

যশোর শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ড. মোঃ আব্দুল মতিন স্বাক্ষরিত চিঠিতে নির্দেশনা ছিলো বোর্ড কর্তৃক প্রশ্ন ব্যাংকের কার্যক্রম স্থগিত এবং স্ব-স্ব বিদ্যালয় পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাবলিক পরীক্ষা ব্যাতিত নিজেরা প্রণয়ন ও পরীক্ষা গ্রহণ করবেন। কোন অবস্থাতেই অন্য কোন উৎস থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করা যাবেনা মর্মে নির্দেশনা দেয়া হয়। তবে শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের নির্দেশনা সরাসরি লংঘন করে ক্ষমতাধর ফুলতলা উজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি নিজেরাই ভুলে ভরা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে উপজেলার ১৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উপর চাপিয়ে দিয়েছে বলে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান প্রধানদের অভিযোগ। আবার এসব স্কুলগুলোতে পরীক্ষার ফিস বাবদ ৫শ’ ও ৪শ’ টাকা আদায় করা হয়েছে। 

ফুলতলা উপজেলার এমপিওভুক্ত ১৭টি মাধ্যমিক ও ২টি কলেজিয়েট স্কুল নিয়ে গঠিত ফুলতলা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি । সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা গত ২৪ জুন থেকে শুরু হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখের ৩৭.০০.০০০.০৭১.০৪.০০২.০২ (অংশ)-৫২৩ নম্বর স্মারকের আলোকে গত ৮ মে ২০২৫ যশোর শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে জানা যায়, অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় স্ব-স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার শিক্ষক কর্তৃক প্রনয়ণকৃত প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা গ্রহণ করবে। কিন্তু শিক্ষাবোর্ডের নির্দেশ লংঘন করে ফুলতলা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি অভিন্ন প্রশ্নপত্রে বেলা ১১টা ও বেলা আড়াইটা থেকে পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায়, মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি গাজী মারুফুল কবিরের প্রতিষ্ঠান জামিরা বাজার আসমোতিয়া স্কুল এন্ড কলেজে পরীক্ষা দু’বেলার স্থলে একবেলা তাও বেলা ১টা ৩০মিনিট থেকে, সমিতির সাধারণ সম্পাদক খাঁন ইমরান আহমেদ হিরোর প্রতিষ্ঠান ফুলতলা রি-ইউনিয়ন স্কুল এন্ড কলেজ বেলা সাড়ে ১১টা থেকে, ধোপাখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় দুপুর ১২টা থেকে, আটরা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় বেলা সাড়ে ১১টা থেকে, শুক্লা স্মরণিকা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় বেলা সাড়ে ১১টা থেকে, বিপিজিডি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বেলা সাড়ে ১১টা থেকে, গাড়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় সকাল ১০টা ও বেলা ১টা ৩০ মিনিট থেকে, আব্দুল লতিফ মেমোরিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয় সকাল ১০ টা থেকে, দামোদর মুক্তময়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয় সকাল ১০টা থেকে, পায়গ্রাম কসবা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১১টা থেকে, রাড়ীপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় সকাল ১০টা ও বেলা ১টা ৩০ মিনিট থেকে পরীক্ষা গ্রহণ করছে। এদিকে পরীক্ষার সময় সূচীর ভিন্নতা থাকায় প্রথমে শুরু হওয়া স্কুলের প্রশ্নপত্র শিক্ষকেরা প্রযুক্তির মাধ্যমে পাঠায় দেরিতে শুরু হওয়া স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে।  

আবার অধিকাংশ শ্রেণীর ভুলে ভরা প্রশ্নপত্রে উত্তর দিতে পরীক্ষার্থীরা হিমশিম খাচ্ছে। সরেজমিনে দেখা যায়, ৭ম শ্রেণীর বাংলা ১ম পত্রে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে অবমাননা ও ২য় পত্রে ১০০ মার্কসের স্থলে ৫০ মার্কস এবং ৩ ঘন্টার স্থলে ২ঘন্টা, ইসলাম শিক্ষার প্রশ্নে এমসিকিউ ৩০টির স্থলে ২৮টি, ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ইসলাম শিক্ষায় সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ১৫টি দেয়ার নিয়ম থাকলেও প্রশ্নপত্রে একটিও দেয়া হয়নি, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়ের প্রশ্নপত্রে ৫ জায়গায় ভুল,্ন ৮ম শ্রেণীর ইংরেজি ১ম পত্রে সিলেবাস বর্হিভূত প্রশ্ন, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ে ৭০ মার্কসের স্থলে ১০০ মার্কস দেয়া এবং ঠিক একইভাবে ভুল ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণীর ইংরেজি ১ম ও ২য় পত্রের প্রশ্নপত্রে। সাধারণ বিজ্ঞান পরীক্ষার প্রশ্নে ৬ষ্ঠ শ্রেণির স্থলে ৯ম শ্রেনি লেখা এবং ৮ নং এমসিকিউতে উত্তরের অপশন নেই। ৭ম শ্রেণির এমসিকিউ এর ৫ ও ৭ নং ভুল এবং সংক্ষিপ্ত  প্রশ্নত্তোর অংশ নেই। গণিত পরীক্ষায় ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণীর এমসিকিউএর ২৮ ও ২৯ নং প্রশ্নের উত্তরের অপশন নেই, ৮ম শ্রেণীর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের ২টি প্রশ্ন নেই। ৯ম শ্রেণীর ১নং সেটের উদ্দীপক নেই এবং সৃজনশীল প্রশ্নের মানানুযায়ী প্রশ্নের সেটিং করা হয়নি। প্রশ্নপত্রে এত ভুল দেখে উদ্বিগ্ন অভিভাবকেরা ক্ষিপ্ত হয়ে স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করছে বলে একাধিক সূত্র জানান। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার উদাসীনতা ও গাফিলতিতে সমিতির ভুলে ভরা প্রশ্ন নিয়ে বিপাকে পড়েছে পরীক্ষার্থী, অভিভাবক ও বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। 

এ ব্যাপারে ফুলতলা রি-ইউনিয়ন স্কুল এন্ড কলেজ অধ্যক্ষ অজয় কুমার চক্রবর্তী বলেন, ভেবেছিলাম অভিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলী দ্বারা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হবে। সে কারণে এবং সমিতির আর্থিক লাভের বিষয়টি ভেবে সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলাম। তবে এত ভুলে ভরা প্রশ্নপত্র আমাদের কাম্য ছিলো না। 

দামোদর মুক্তময়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এসএমএ হালিম বলেন, সকল প্রশ্নপত্রে ভুল থাকায় প্রতিনিয়ত সচেতন অভিভাবকরা শিক্ষকদের হেয় প্রতিপন্ন করে কথা বলছে যেটি কিনা শিক্ষক সমাজের জন্য অবমাননাকর। 

আব্দুল লতিফ মেমোরিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ গোলাম মোস্তফা বলেন, সময়ের স্বল্পতার কারণে সমিতি থেকে প্রশ্নপত্র নেয়া হয়। তবে এমন ভুলে ভরা প্রশ্নপত্র আমাদের কাম্য ছিলোনা। তওবা করেছি ভবিষ্যতে প্রশ্ন সংক্রান্ত কোন বিষয়ে আমার স্কুল সমিতির সাথে নেই যা সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বলে দিয়েছি। 

গাড়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাপস কুমার বিশ্বাস বলেন, পরীক্ষা শুরুর পূর্বে মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি সকল প্রধান শিক্ষকদের সমিতির কার্যালয়ে ডেকে সমিতি থেকে প্রশ্ন নেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় যদিও আমি বোর্ডের নির্দেশনা ওই মিটিং এ তুলে ধরেছিলাম।

এ ব্যাপারে সমিতির সভাপতি অধ্যক্ষ গাজী মারুফুল কবিরের সাথে তার দুটি মোবাইল নং এ বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে প্রশ্নপত্র মডারেশন কমিটির আহবায়ক ও শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খাঁন ইমরান আহমেদ হিরো ভুলে ভরা প্রশ্নপত্রের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, গ্রীষ্মকালীন ছুটির কারণে প্রশ্ন তৈরি দেরি হয়েছে। ফলে প্রেসগুলো প্রশ্নের কাজ নিতে না চাওয়ায় শেষ অবদি দুটি প্রেসে ভাগ করে প্রশ্ন তৈরি করা হয়। প্রুভড দেখার দ্বায়িত্বে থাকা আটরা শ্রীনাথ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহাসিন বিশ্বাস ও আমার ট্রেনিং থাকায় এবং আটরা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিমান নন্দী অসুস্থ্য থাকায় প্রুভড ছাড়াই প্রশ্নপত্র ছাপা হয়েছে।আশা করি বিষয়টি সবাই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। যদিও প্রশ্ন সংক্রান্ত বিষয়ে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সম্মানীবাবদ ১০ হাজার ৬শত টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।

প্রশ্নপত্রের ভুল-ক্রটি সম্পর্কে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফাতেমা বেগম এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৭ম শ্রেণীর বাংলা প্রশ্নে মহানবী (সাঃ) সংক্রান্ত বিষয়টিসহ বিভিন্ন শ্রেণীর প্রশ্নপত্রের ভুল আমার দৃষ্টিগোচর হওয়ায় ইতোমধ্যে আমি সমিতির কর্মকর্তাসহ সকল প্রধান শিক্ষকদের নিয়ে মিটিং করে কড়া হুশিয়ারি প্রদান করেছি এবং সকল শ্রেণীর প্রশ্নপত্র আমার কাছে জমা দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছি। চলমান পরীক্ষা শেষে যাচাই বাছাই করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, যশোর এর বিদ্যালয় পরিদর্শক ড. মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বোর্ডের প্রশ্নব্যাংক সিস্টেম বাতিল করে স্ব-স্ব বিদ্যালয়কে প্রশ্নপত্র প্রণয়নের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে ফুলতলা উপজেলার মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহ নির্দেশনা উপেক্ষা করে শিক্ষক সমিতির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও পরীক্ষা গ্রহন - এটি জানা ছিলো না। ঘটনা তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে