ধর্ষণরোধে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী

মো. শামীউল আলীম শাওন | প্রকাশ: ১২ জুলাই, ২০২৫, ০৬:৫২ পিএম
ধর্ষণরোধে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী
মো. শামীউল আলীম শাওন

‘বাবা কর্তৃক ধর্ষিতা মেয়ের মামলা, মা-ও আসামী!’ শিরোনামে ২০২২ সালের ৫ নভেম্বর ‘সোনার দেশ’ পত্রিকায় প্রথম পাতায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেই সংবাদ সূত্রে জানা যায়, মায়ের সহযোগিতায় কিশোরী মেয়েকে যৌন নিপীড়নসহ ধর্ষনের অভিযোগ উঠেছে জন্মদাতা পিতার বিরুদ্ধে। ২০১৮ সাল থেকে বাবার লালসার  শিকার হচ্ছেন ১৫ বছর বয়সী ওই কিশোরী।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের সূত্রে জানা গেছে যে, ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক গৃহবধূকে বর্বরোচিত পাশবিক নির্যাতন করে চার যুবক এবং এ ঘটনার ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল করার ভয় দেখিয়ে অনৈতিক প্রস্তাব ও টাকা দাবী করে এবং এক পর্যায়ে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ঐ বছরের ২৫শে সেপ্টেম্বর শুক্রবার বিকেলে নিজেদের গাড়িতে স্বামীর সাথে এক তরুণী সিলেটের এমসি কলেজ এলাকায় বেড়াতে যান। রাতে কলেজের প্রধান ফটকের সামনে স্বামীকে গাড়িতে আটকে রেখে তিনজন যুবক স্ত্রীকে ছাত্রাবাসের একটি কক্ষের সামনে তুলে নিয়ে যায় এবং গণধর্ষণের ঘটনা ঘটায়। এছাড়া হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় ডাকাতি করতে এসে মা ও মেয়েকে গণধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব বলছে যে, ২০২০ সালে ১৬২৭ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার যার মধ্যে গণধর্ষণ ৩১৭ জন আর ধর্ষণ চেষ্টার শিকার ৩২৬ জন হয়েছিল  । আর ২০১৮ সালে ৭৩২ জন   ও ২০১৯ সালে ১৪১৩ জন   ধর্ষণের শিকার হয়। ২০২১ সালে ১৩২১ জন ধর্ষণ, ২৫২ জন গণধর্ষণ আর ২৯৩ জন ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হন  । ২০২২ সালে ৯৩৬ জন ধর্ষণ  , ২০২৩ সালে ৫৪৭ জন ধর্ষণ, যার মধ্যে গণধর্ষণ ১৩৮ জন  , ২০২৪ সালে ৪০১ জন ধর্ষণ যার মধ্যে গণধর্ষণ ১০৫জন  ,

আসকের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৫ সালের জানুয়ারি-মে পর্যন্ত নারীর প্রতি সহিংসতা (পারিবারিক নির্যাতন) ঘটনা ঘটেছে ২৫১টি  , ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৮৩টি যার মধ্যে গণধর্ষণ ৯৭টি  , যৌনহয়রানির শিকার হয়েছে ১০০ জন নারী ও শিশু আর সহিংসতার শিকার হয়েছে ৪৯৭ শিশু  ।

সম্প্রতিকালে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী চলন্ত বাসে ডাকাতি ও নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানি  , ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক চলন্ত বাসে ডাকাতি নারীর শ্লীলতাহানি , লালমনিরহাট-ঢাকা রুটে চলাচলকারী আন্তঃনগর ট্রেন লালমনি এক্সপ্রেসে এক কিশোরীকে ধর্ষণ , সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী চলন্ত ট্রেন উদয়ন এক্সপ্রেসে এক তরুণীকে ধর্ষণ , কমলাপুরে ট্রেনে যাত্রীকে ধর্ষণ , কুমিল্লার মুরাদনগরে উপজেলার রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের বাহেরচর পাচকিত্তা গ্রামে দুই সন্তানের জননী এক নারীকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ   ও ধর্ষণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় চার স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ , গাইবান্ধায় গোপন ভিডিও দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে ছাত্রীকে ধর্ষণ   ও নাটোরের বড়াইগ্রামে শিশু ধর্ষণ চেষ্টার   ঘটনা সহ চলমান নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনাগুলো উদ্বেগজনক।

আজ দেশেজুড়ে নারী ও শিশুরা সহিংসতা, যৌনহয়রানি, নির্যাতন ও ধর্ষণ এবং গণধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। এ পেছনে একটা বড় কারণ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত অপরাধীর আইনানুগ কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হওয়া এছাড়াও ধর্ষিতা ও তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা এবং তাদের চরিত্র হনন করা। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমরা যদি বের না হতে পারি তবে আমদের দেশ থেকে ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধ রোধ করা সম্ভব হবে না। সকলকে সম্মিলিতভাবে এর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন ধর্ষণের মত ঘটনায় যেন কোনও নিরাপরাধ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত না করা হয়।

‘‘বাংলাদেশে ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির সহজ বিস্তার এবং নারীর প্রতি সহিংসতা”   (সূত্র: ডিনেট এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন) শীর্ষক একটি গবেষণায় বলা হয়েছে দেশীয় অনলাইন ও মিডিয়াতে নারীর প্রতি অবমাননাকর, নারীর অশালীন দেহ প্রদর্শন, যৌন আবেদনময় ও পর্নোগ্রফিক কনটেন্ট বা আধেয় বাড়ছে। দেশব্যাপি এই গবেষণাটি স্পষ্টভাবে তুলে এনেছে যে, পোশাক বা আচরণ দেখে মুহুর্তেই কোন মেয়েকে ‘ভাল মেয়ে’ বা ‘মন্দ মেয়ে’ হিসাবে বিচার করার প্রবণতা বাড়ছে। এবং ‘মন্দ মেয়ে’ বলে মনে হলে তাদের উপর আক্রমণের মানসিকতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, আক্রমণ করাটাকেও আক্রমণকারীরা যৌক্তিক বা জায়েজ বলে মনে করেন। দেশেজুড়ে ধর্ষন, যৌন নিপীড়নসহ নারী ও শিশু নির্যাতন ও সহিংসতা বৃদ্ধির পেছনে এটাও অনেক ভূমিকা রাখছে।

গবেষণা বলছে, ‘ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফি সহজলভ্য হওয়ার কারণে নারীর প্রতি পুরুষের অবমাননাকর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সহিংসতা বেড়েছে।’ আর গবেষণায় সুপারিশে বলা হয়েছে, ‘এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে পর্নোগ্রাফির বিষয়টিকে শুধু নৈতিকতার দৃষ্টিতে দেখলে হবে না, এটি যে বড় একটি সামাজিক ক্ষতি করছে বিষয়টিকে সেভাবে দেখতে হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।’   এ বিষয়েও নজর দেয়া জরুরী।

পুলিশ সদরদপ্তর হতে গত ১০ জুন ২০১৫ তারিখে (স্মারক নং-না: ও শি: নি: প্র: সেল /সার্কুলার/৪৪.০১.০০০০.০৪৭.০১.০১১.১৫২২৩/১(১০৫) নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা দায়ের সংক্রান্ত কিছু দিক-নির্দেশনা প্রদান করে একটি পরিপত্র জারী হয়। জারীকৃত পরিপত্রের ৩নং নির্দেশনা হচ্ছে, ‘ধর্ষন, যৌন নিপীড়নসহ নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত অপরাধের কোন অভিযোগ থানায় আসার সাথে সাথে কোন পকার বৈষম্য ও বিলম্ব ছাড়াই মামলা রুজু করতে হবে’।

অথচ দেখা যায় এমন ঘটনায় ভুক্তভোগী থানায় সহায়তার জন্য গেলে অনেক সময় মামলা নেওয়া হয়না। এতে দেশে বিচারহীনতার উদাহরণ বেড়ে যাচ্ছে। তাই গুরুতর ও স্পর্শকাতর অপরাধগুলোর বিচারকার্য দ্রুত সম্পন্ন করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মতো জঘন্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি নাগরিকদের পারিবারিক ও নৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়ন করতে হবে। সমাজের প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া নারী সহিংসতা বন্ধে শুধু সরকারের ওপর দায়িত্ব দিয়ে দিলেই হবে না। সবার আন্তরিক সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ ছাড়া এই ভয়াবহ ব্যাধি সরকারের একার পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা। তিনি তার একটি লেখায় (গণমাধ্যমে প্রকাশিত) বলেছেন যে, ‘বাংলাদেশে অনেক কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও অনেক নারী ও মেয়ে প্রায়ই আইনের অধীনে অর্থবহ আইনি প্রতিকার পান না এবং এর ফলে নির্যাতনকারীদের খুব কমই বিচারের আওতায় আনা যায়। অনেক ক্ষেত্রে বিচার প্রায় বিলম্বিত হয় বা বছরের পর বছর ধরে টানা হয়। কোনো সাক্ষী সুরক্ষা আইন এ ব্যবস্থা গ্রহণ না করা, নির্যাতনকারীদের ভয় বা হুমকি, আদালতে মামলা চালিয়ে যাওয়ার আর্থিক ও মানসিক চাপের কারণে অনেক নারী প্রায়ই আদালতের বাইরে আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করে ফেলেন।’  

নারীর অধিকার মানবাধিকার, নারী নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন। নারীর অধিকার শুধুমাত্র মানবাধিকারের ইস্যু নয়, এটি সামাজিক ন্যায় বিচারের অংশ। সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের অপরিহার্য অংশ নারীরা। তাই নারীর সামাজিক ন্যায়্যবিচার নিশ্চিত করতে হবে।

গত ২০২০ সালে দেশজুড়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন হয়। এ ঘটনার ৫টি বছর অতিবাহিত হলেও অদ্যবধি নারী ও শিশু নির্যাতন-ধর্ষণ বন্ধ হয়নি। ধর্ষণ এবং নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় চলতি বছরেও আন্দোলন হয়েছে। দুঃখজনক বিষয় হলো কঠোর আইন, প্রচার-প্রচারণা ও উচ্চ আদালতের নানা ধরনের নির্দেশনার পরও নারীর প্রতি সহিংসতা কমানো যাচ্ছে না। বরং দিন দিন এর মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঊর্ধ্বগতি সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। এদিকে শুধু ধর্ষণই নয় বর্তমানে ধর্ষণের ভিডিওচিত্র ধারণ করে সেই ধারণকৃত ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়াও হচ্ছে। যা কিনা রীতিমত ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে।

গণঅভ্যুথান পরবর্তী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে জননিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়টি অবহেলিত। ফলে ক্রমশই তা অবনতির দিকে যাচ্ছে। তাই সকারের উচিৎ দেশজুড়ে নারী ও শিশু সহ সার্বিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা।

লেখক ও উন্নয়নকর্মী