মু. নজরুল ইসলাম তামিজী, একাধারে কবি, সমাজবিজ্ঞানী ও মানবাধিকার চিন্তক। বাংলাদেশের বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার ভুবনে তিনি আলোড়ন তুলেছেন “হোমোক্রেসি” (মানবতন্ত্র) নামক এক অভিনব তত্ত্ব প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে। তাঁর মতে, ডেমোক্রেসি উন্নয়নশীল দেশে নেতৃত্ব সংকট, দলীয় রাজনীতি ও নৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফাঁদে পড়ে কার্যত ব্যর্থ হচ্ছে। তাই প্রয়োজন এক নতুন, নৈতিকতাভিত্তিক নেতৃত্বব্যবস্থা — হোমোক্রেসি।
এক অন্তরঙ্গ আলাপে তিনি তুলে ধরেন তাঁর জীবনদর্শন, রাষ্ট্রভাবনা ও হোমোক্রেসির তাৎপর্য।
এফএনএস : আপনি মানবতন্ত্র বা হোমোক্রেসি তত্ত্ব প্রবর্তন করেছেন ২০০৪ সালে। তখন বাংলাদেশ বা বিশ্বে গণতন্ত্র নিয়ে এত সমালোচনা হয়নি। কেন এই তত্ত্বের প্রয়োজন বোধ করেছিলেন?
মু. নজরুল ইসলাম তামিজী : ২০০৪ সাল ছিল বিশ্ব ও বাংলাদেশের জন্য রাজনৈতিকভাবে এক সন্ধিক্ষণের সময়। তখনও “গণতন্ত্র ব্যর্থ হচ্ছে” এই বক্তব্য সরাসরি উচ্চারিত হতো না। কিন্তু আমি রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞানের গবেষক হিসেবে দেখছিলাম, গণতন্ত্রের অন্তঃসারশূন্যতা কীভাবে নীরবে বিস্তার লাভ করছে।
আমি হোমোক্রেসি প্রবর্তন করি এই উপলব্ধি থেকে— যে গণতন্ত্র কেবল পদ্ধতির নাম নয়, সেটি হতে হবে আদর্শের বিকাশ।
হোমোক্রেসি কোনো সংস্কারতাত্ত্বিক দিক নয়; এটি একটি মৌলিক, বিকল্প রাষ্ট্রতত্ত্ব। গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র— সব কিছুর বাইরে দাঁড়িয়ে হোমোক্রেসি নেতৃত্বকে সংজ্ঞায়িত করে গুণ, মানবতা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে। আমার মতে, গণতন্ত্র ‘কীভাবে শাসন করবেন’ তা বলে, কিন্তু হোমোক্রেসি বলে ‘কে শাসন করবেন’।
২০০৪ সালের বৈশ্বিক বাস্তবতা আমাকে কী দেখিয়েছে?
এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমি বুঝি—
“আমাদের দরকার এক নতুন রাষ্ট্রদর্শন, যা গণতন্ত্রের কাঠামোর ভেতর থেকেও নেতৃত্বের বৈপ্লবিক সংজ্ঞা দেবে।”
সেই তত্ত্বই মানবতন্ত্র বা হোমোক্রেসি।
হোমোক্রেসি কী চায়?
ভোট নয়, যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব।
জনপ্রিয়তা নয়, নৈতিকতা ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে শাসনক্ষমতা।
ক্ষমতার লড়াই নয়, কল্যাণমুখী দায়িত্ব।
গোষ্ঠীবদ্ধ লুট নয়, সাম্য ও ন্যায়ের অভিন্ন কাঠামো।
আমি ২০০৪ সালে হোমোক্রেসি প্রবর্তন করেছি পশ্চিমা ও প্রাচ্য উভয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল্যবোধগত ব্যর্থতার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে।
এটি কেবল প্রতিক্রিয়াশীল নয়, বরং একটি প্রো-অ্যাকটিভ রাষ্ট্রতত্ত্ব — যা ভবিষ্যতের নেতৃত্ব ও নাগরিক সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
হোমোক্রেসি (মানবতন্ত্র) এখন শুধু প্রয়োজন নয় — এটি অনিবার্য।
এটাই আমার বিশ্বাস, গবেষণা ও অভিজ্ঞতার সারাংশ।
এফএনএস : তাহলে কি আপনি গণতন্ত্রকে পুরোপুরি বাতিল করতে চাচ্ছেন?
মু. নজরুল ইসলাম তামিজী : আমি গণতন্ত্র বাতিল করতে বলিনি। আমি বলেছি, গণতন্ত্র যদি গুণহীনতা, বংশবাদের দায়, পুঁজির চক্রান্ত, কিংবা জনতাকে ভুল পথে চালিত করার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায় — তখন সেটি আর জনগণের শাসন নয়, সেটি একটি নাট্যাভিনয়।
হোমোক্রেসি সেই নাট্যাভিনয়ের অন্তরালে সত্য নেতৃত্বের সন্ধান।
এটি নতুন, মৌলিক, ভবিষ্যতমুখী রাষ্ট্রদর্শন, যেটি গণতন্ত্রকে ছাপিয়ে যায় — তার আত্মাকে উদ্ধার করে।
এই দর্শনে আমি বিশ্বাস করি, এবং আমি জানি, ভবিষ্যৎ একদিন এই পথেই হাঁটবে।
এফএনএস : হোমোক্রেসি কথাটার অর্থ কী?
অর্থাৎ, নেতৃত্বের আসনে বসবে সেই ব্যক্তি, যিনি নৈতিক, গণমান্য ও প্রজ্ঞাবান।
এফএনএস : বাস্তবায়নের পথ কী? আমাদের দেশে তো নির্বাচন মানেই পেশিশক্তি, পয়সা, পরিচয়...
মু. নজরুল ইসলাম তামিজী: এ জন্যই হোমোক্রেসি শুধু রাজনৈতিক তত্ত্ব নয় — এটি একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনও। আমি হোমোক্রেসিকে বলি রাষ্ট্রের নৈতিক রেনেসাঁ।
নাগরিকদের মধ্যে যদি মূল্যবোধ জাগে — মানুষ যদি বুঝে যোগ্যতার চেয়ে বড় পরিচয় কিছু নেই, তখন ধীরে ধীরে এই নেতৃত্ব আসবে।
এই ব্যবস্থায় স্থানীয় সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়, পেশাজীবী সংগঠন — সব জায়গায় নেতৃত্ব নির্বাচন হবে নৈতিক ও জ্ঞানভিত্তিকভাবে।
এফএনএস : আপনি কবি। কবি হয়ে রাষ্ট্রচিন্তায় এলেন কেন?
মু. নজরুল ইসলাম তামিজী: রাষ্ট্রে যদি কবিতা থাকে না, তাহলে তার শাসন হবে নিষ্ঠুর।
আর কবিতায় যদি রাষ্ট্র থাকে না, তাহলে সে কবিতা আত্মকেন্দ্রিক।
আমার কবিতা, গবেষণা আর মাঠের অভিজ্ঞতা — এই তিন মিলে আমি বুঝেছি, নেতৃত্বের সংকটই আমাদের সব সমস্যার মূলে। তাই আমি হোমোক্রেসি বলি — "নেতৃত্বের কবিতা, রাষ্ট্রের গদ্য"।
এফএনএস : আপনার তত্ত্ব কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে?
মু. নজরুল ইসলাম তামিজী : আন্তর্জাতিকভাবে একাধিক গবেষণাপত্র হোমোক্রেসিকে দার্শনিক ও রাজনৈতিক সম্ভাবনা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দেশেও এটি নিয়ে গবেষণা চলছে।
মূল কথা হচ্ছে, আমরা যদি চেতনাগত পরিবর্তন না আনি, শুধু কাঠামো পরিবর্তন করে কোনো লাভ হবে না। হোমোক্রেসি মানুষ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ককে মূল্যবোধভিত্তিক করে তোলে।
এফএনএস : আপনি ভবিষ্যতের রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে হোমোক্রেসিকে কতটা বাস্তব মনে করেন?
মু. নজরুল ইসলাম তামিজী : আমি বিশ্বাস করি, ২১শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিশ্বজুড়ে নেতৃত্বের পুনর্নির্মাণ শুরু হবে। নৈতিক দুর্ভিক্ষ যত গভীর হবে, মানুষ তত বেশি গুণী নেতৃত্বের খোঁজে যাবে।
সেই দিগন্তেই হোমোক্রেসি দাঁড়াবে বিকল্প আলোকবর্তিকা হয়ে।
এফএনএস : আপনি আজকের তরুণদের কী বলবেন?
মু. নজরুল ইসলাম তামিজী : নিজেকে তৈরি করো — জ্ঞান, প্রজ্ঞা, নৈতিকতা দিয়ে। তুমি যদি সত্যিকারের যোগ্য হও, জনগণ তোমাকে নেতৃত্বে আনবেই।
হোমোক্রেসি তোমাকেই চায়।