বাংলাদেশকে কোথায় কে কীভাবে নিয়ে যেতে চায়, তা প্রথম ক্ষমতায় আসার পর প্রথম ৩ মাসে বোঝা না গেলেও ৬ মাস পর থেকে অনুমেয় হয়ে ওঠে। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর অর্থাৎ একাত্তরের পরবর্তী সময়ের ইতিহাস দেখলেই বোঝা যায়। সেই ইতিহাস বলে- স্বাধীনতার পর টানা ১০ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ সম্পূর্ণ মাদকমুক্ত না থাকলেও বিদেশি মদ আর বিয়ার পেতে প্রচণ্ড ঝক্কি পোহাতে হতো তৎকালীন কূটনীতিক ও ধনী শ্রেণির মানুষকে। সেই অবস্থা থেকে একটু সামনে এগুতেই সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের সময় ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে মাদকদ্রব্য চোরা চালান হয়ে আসা শুরু করে বাংলাদেশে। সেই যে শুরু এখন দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। যার ৮০ ভাগই কিশোর-তরুণ। দেশে প্রতিবছর ১৮ ধরনের মাদকের প্রবেশের বিপরীতে বিদেশে পাচার হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এমন প্রেক্ষাপটে দেশে পালিত হয় বিশ্ব মাদকবিরোধী দিবস। সেই দিবস পালনে যারা নেতৃত্ব দেয়, তারাও নিজের জানা বা অজান্তে মাদকদ্রব্যে বাংলাদেশকে সয়লাবে ব্যস্ত হয়ে যায় প্রায়শই। কারণ ‘মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধ কমিশন’ না করে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমলা-মন্ত্রী-এমপি-ব্যবসায়ী আর দুষ্টুচক্রের সমন্বয়ে সিদ্ধান্ত হয়- ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর’ করার। এতে করে মাদকদ্রব্য বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নীরবে পৌঁছে দেয়ার রাস্তাটা আরো প্রশস্ত হয়। অলিতে-গলিতে গজিয়ে ওঠে মিনি বার, শহরে রেগুলার বারের পাশাপাশি সমাজ বিধ্বংসী বিভিন্ন ধরনের ক্লাব বা হোটেলও গড়ে তোলে লোভি-লম্পট-সমাজবিরোধী-ধর্ম-মানবতাবিরোধী এক কুচক্রী সমাজ। যারা রাতের আঁধারে মাদকের বাণিজ্য জমজমাট করার পাশাপাশি দিনের আলোতে সাজে সমাজকর্মী-শিক্ষানুরাগী ও ধর্মপ্রবণ। মাঝে মাঝে মসজিদে-মন্দিরে-মাদ্রাসা বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে তারা বড় বড় ডোনেশন দিয়ে কিনে নেয় সস্থা জনপ্রিয়তা। তার উপর আবার প্রতি বছর স্থানীয় মাদকসেবীদের একটি অংশকে কাজে লাগিয়ে ‘অমুকপাড়া মুসলিম তরুণ সমাজ’-এর ব্যানারে ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন করে ২/৩ লাখ টাকা খরচ করে ধর্মীয়ভাবে এলাকার মানুষের কাছে প্রিয় পাত্রও হয়ে ওঠে। মধ্যখানে নীরব ঘাতকের মত আমার-আপনার-আমাদের সন্তানদের হাতে অবলীলায় প্রথমে সিগারেট, পরে গাঁজা এবং তারপর কৌশলে তুলে দেয়া ভয়ংকর সব মাদকদ্রব্য। বিশেষ করে রাজধানীর কথাই যদি বলি- অগণিত মানুষের বসবাস আর এক অদ্ভুত গতির শহর ঢাকা। আলো ঝলমলে নগরীতে আছে অন্ধকারও। অলিগলি থেকে সুরম্য অট্টালিকা-সবখানে মাদক এখন সহজলভ্য। বেসরকারি সংগঠন মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার গবেষণা বলছে, শুধু নেশার খরচ জোগাতে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে ৩০ শতাংশ মাদকাসক্ত। মা-বাবা, ভাই-বোনের মতো আপনজনকেও খুন করতে দ্বিধা করছে না তারা। এক্ষেত্রে একজন সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই আমি আমার নেতৃত্বে গড়ে তুলি ‘মাদক বিরোধী আমরা’ নামক সংগঠন। সেই সংগঠন থেকে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে লেখালেখি- পোস্টার- দেয়াল লিখনের মাধ্যমে ধূমপান থেকে বিরত থাকার ও রাখার বিষয়ে কাজ করি। ২০০০ সাল থেকে ক্রমশ সেই যুদ্ধে আমার সাথে অনেকেই যুক্ত হয়েছেন এবং নিজেদেরকে ধুমপানমুক্ত রেখে জীবন চালাচ্ছেন। আমি একজন লেখক হিসেবে বরাবরই বিশ্বাস করেছি- মাদক সেবনের প্রথম ধাপ ধূমপান। এর কারণে প্রতিবছর দেশে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ৬০ হাজার শিশু-কিশোর, আর ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন ১ লাখ ৫৫ হাজার মানুষ। শুধু কি এখানেই শেষ! বাংলাদেশে যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, এই মাদকের পক্ষেই কাজ করেছে, ছাত্র-যুব-জনতাকে ঠেলে দিয়েছে অন্ধকারের পথে, কেবল ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে। যে কারণে মাদকাসক্ত সমাজ নিয়েই একপ্রকার খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে বাংলাদেশ নামক একটি দেশ। যে দেশটাকে কখনো উন্নয়নের রূপালী দেশ, কখনো ডিজিটাল দেশ, কখনো স্মার্ট দেশ বা কখনো সংস্কারের দেশ হিসেবে বললেও কোনো ক্ষমতাবাজ-ই ‘মাদকমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, খুন-গুম-ধর্ষণমুক্ত’ করার অঙ্গীকার করেনি। হয়ত এই সুযোগে গড়ে উঠেছে মাদকের রামরাজত্ব। দেশে এ পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে ২৭ ধরনের মাদক। এর মধ্যে ১৮ ধরনের ব্যবহার বেশি। সরকারি তথ্য বলছে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। যার ৮০ ভাগই কিশোর-তরুণ। প্রতিদিন গড়ে একজন মাদকের জন্য খরচ করে কমপক্ষে ২২০ টাকা, যা বছরে দাঁড়ায় ৮০ হাজার ৩০০ টাকায়। এই হিসাবে বছরে দুই কোটি মাদকাসক্তের ব্যয় প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকা। সিগারেট-বিড়ি-পান-জর্দা বা আনুষঙ্গিক তামাকজাত দ্রব্য বিক্রির কথা বাদ-ই দিলাম। তবে এতটুকু বলে রাখি- জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মাদকের পেছনে খরচের সিংহভাগই পাচার হচ্ছে বিদেশে। এই খাতের ব্যয়ে বিশ্বে পঞ্চম আর এশিয়াতে শীর্ষ স্থানে বাংলাদেশ। অনেকেই বলেন, মাদকের ডিলারদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। প্রশাসন চাইলেই এটি সম্ভব। আর এটি করা গেলে মাদকের ব্যবহার কমে আসবে।’ কিন্তু না, এভাবে না। ‘মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধ কমিশন’ গঠনের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মাদক বিক্রি-ক্রয়কে যেমন নিষিদ্ধ করতে হবে, তেমন বন্ধ করতে হবে ভয়াবহ দুর্নীতির রাস্তা হিসেবে ব্যাপক পরিচিত ‘মদের লাইসেন্স’-এর প্রক্রিয়াও। সেই সাথে ধূমপানে নিরুৎসাহিত করতে সরকারিভাবে বিভিন্ন কড়াকড়ির আইনও বাস্তবায়ন করতে হবে। যেমন- ধূমপান নির্ধারিত স্থান ব্যতীত প্রকাশ্যে করলে কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ১৫ দিনের জেল-এর মত কার্যকরী আইন প্রয়োগ। তাছাড়া মনে রাখতে হবে- মাদক প্রবেশের পথগুলোতে দায়িত্বে থাকা অসাধু কর্মকর্তাদের অর্থের লোভে নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার মানুষের জীবন। এটি কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। তাই অসাধুরা ঝুঁকে পড়ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। ‘সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে সেটি তাড়ানো সম্ভব নয়’ প্রবাদটি মনে করিয়ে দিয়ে আমি বলতে চাই- অনতিবিলম্বে ‘মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধ কমিশন’ গঠনে কার্যকর পদক্ষেপ নিন- দেশ বাঁচান। আন্দোলন, সংগ্রাম, আড্ডা বা নিত্যদিনের অনেক কিছুতেই এখন শিক্ষার্থী-তরুণদের একটি বড় অংশ মাদকের আসর বসায়। যে কারণে তাদের অধিকাংশেরই কথাবার্তা অসংলগ্ন হয়ে উঠছে গত ২০ বছর ধরে। হয়ে উঠছে চরম প্রতিহিংসা পরায়ণও। হয়তো এদের কারণেই প্রতিদিন ঢাকাসহ সারাদেশেই মাদকের চাহিদা বেড়ে চলেছে। একদিকে যেমন চাহিদা বাড়ছে, অন্যদিকে আমদানি ও সরবরাহ দুটোই বেড়ে চলেছে। চাহিদা ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ নয়, নিষিদ্ধ করা না গেলে দেশে কখনোই মাদকের প্রভাব রোধ করা সম্ভব নয়; একথা যেমন সত্য, তেমন সত্য সন্ত্রাস- নৈরাজ্য-দুর্নীতিও রোধ করা অসম্ভব। এই নৈতিক পদক্ষেপের অভাবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলের অলিগলি থেকে শুরু করে শহরের পাড়া-মহল্লা, অভিজাত স্থাপনা, রেস্তোরাঁ ও ক্লাব। সর্বত্রই মিলে মাদক। পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী ছাড়াও মুদির দোকানি চায়ের দোকানি, রিকশা চালক, পথশিশু, রাজনৈতিক ব্যক্তি, অসাধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীরা মাদক বিক্রির সঙ্গে জড়িত। অনলাইনে অর্ডার করলে শয়নকক্ষেও চলে আসে মাদক। সরকারি সংস্থাগুলো বলছে দেশে মাদকের বিরুদ্ধে চলছে জিরো টলারেন্স নীতি। তাদের ভাষ্যমতে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে। মাদক নির্মূলে সব ধরনের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। অথচ বাস্তব চিত্র উল্টো। মাদকে সয়লাব হয়েছে দেশ। হাত বাড়ালেই মিলে মাদক। পুরাতন আমলের মাদক থেকে শুরু করে সর্বশেষ আবিষ্কার হওয়া মাদকও এখন হাতের নাগালে। ব্যয়বহুল অভিজাত মাদক আইসও এখন হরহামেশা পাওয়া যায়। ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজার পাশাপাশি কুশ নামক এক ভয়াবহ মাদকও এখন মাদকসেবীদের পছন্দের তালিকায়। শুধুমাত্র বছরে কয়েক লাখ ইয়াবা ট্যাবলেট, কয়েক মণ গাঁজা, কয়েক কেজি আইস ও হাজারখানেক বোতল ফেনসিডিলসহ অন্যান্য কিছু মাদক উদ্ধার করে চলছে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সেই সঙ্গে কিছু মানুষকেও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা সঙ্গে সঙ্গে অথবা সপ্তাহখানেকের ভেতরে তারা নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করে স্থায়ী ও অস্থায়ী জামিন নিয়ে দিব্যি আবার প্রকাশ্যে ঘুরেফিরে মাদক ব্যবসা করছে। এতে করে দেশে যেমন মাদকের ছড়াছড়ি বেড়েছে ঠিক তেমনি মাদকসেবীদের সংখ্যা রাতারাতি বাড়ছে। লাভজনক ব্যবসা হওয়াতে যারা মাদকসেবী তারা মাদকের কারবারেও জড়াচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশকে মাদক পাচারের রুট হিসেবেও ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক মাদক কারবারিরা। সরাসরি মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধে কোনো সরকারই পদক্ষেপ না নেয়ায় উদ্ভট সব উদ্যোগ, লোক দেখানো পরিকল্পনা দেশে মাদকের অবাধ প্রবেশ ঠেকানোর পরিবর্তে অবাধ ও সহজলভ্য করে তুলছে। শুধু এখানেই শেষ নয়; সীমান্তে বিভিন্ন অযুহাতে আমাদের ভাই- বোনকে হত্যা করলেও পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে দেশের সীমান্ত দিয়ে দিনে-রাতে অবাধে দেশে মাদক প্রবেশ করছে। মাদক পাচারের জন্য স্থল, নৌ, আকাশ পথ ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিটা রুটেই মাদক পাচারে সহযোগিতা করে কিছু অসাধু কর্মকর্তা। যেন কেউ দেখেও দেখছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রমরমা ব্যবসা করছে মাদক ব্যবসায়ীরা। বছর ঘুরতেই এসব কারবারিরা কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছে। অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। এসব মাদকের গডফাদার ব্যবসায়ীদের অনেকেই সরকারি সংস্থাগুলোর তালিকাভুক্ত। অথচ তারা কখনোই গ্রেপ্তার হন না। বিভিন্ন অভিযানে শুধু মাদকের বাহকরাই গ্রেপ্তার হয়। আর গডফাদাররা দেশে-বিদেশে বসে দিব্যি কারবার চালিয়ে যায়। এমতাবস্থায় একটা সমাধানের রাস্তা; তা হলো- ‘মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধ কমিশন’ গঠন এবং মাদকদ্রব্য বহন-বিক্রি-ক্রয়-সেবন করলে কমপক্ষে ১০ বছরের সাজার আইন করে তা বাস্তবায়নের পাশাপাশি নেয়া হোক কার্যত-পরিকল্পিত পদক্ষেপ...
লেখক: মোমিন মেহেদী; ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক পূর্বাভাস