দেশের নিরাপত্তা, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং ইতিহাসের প্রতি সম্মান- এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে সোমবার (১৪ জুলাই) কক্সবাজারে দিনভর নানা কর্মসূচিতে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। রোহিঙ্গা সংকট, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ এবং সম্প্রতি আলোচনায় থাকা ‘মব ভায়োলেন্স’ নিয়ে বক্তব্য রাখার পাশাপাশি তিনি জুলাই অভ্যুত্থানের শহিদদের স্মৃতিরক্ষায় নির্মিতব্য স্মৃতিস্তম্ভের কাজের উদ্বোধন করেন।
কক্সবাজারের বিজয় সরণি সড়কের হোটেল শৈবালসংলগ্ন স্থানে নির্মিত হচ্ছে জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ। সকালে এর উদ্বোধনকালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “জুলাই যোদ্ধাদের রক্তের ওপরই নতুন বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে। তাদের অবদান শুধু তারিখে-তারিখে নয়, প্রতিনিয়ত স্মরণ করতে হবে। জুলাই যোদ্ধাদের অবদানের কারণেই আমরা স্বৈরাচারমুক্ত দেশ পেয়েছি।” তিনি আরও বলেন, “জুলাইয়ে নিহত ও আহতদের যে অবদান, তা কখনো টাকা দিয়ে পোষানো যাবে না। তবু আমরা আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করছি। এই স্মৃতিস্তম্ভ শুধুমাত্র দিবসের আনুষ্ঠানিকতার জন্য নয়, বরং প্রতিনিয়ত তাদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করাবে।”
এ সময় উপস্থিত ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম (বীর প্রতীক), জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নিজাম উদ্দিন আহমেদসহ স্থানীয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও অতিথিরা। জেলা প্রশাসক জানান, পূর্ত বিভাগ ও জেলা প্রশাসন যৌথভাবে স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছে।
স্মৃতিস্তম্ভের উদ্বোধন শেষে দুপুর ১২টায় কক্সবাজারের বিয়াম ফাউন্ডেশন আঞ্চলিক কেন্দ্রের মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ’ বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের সমন্বয় সভা। সভায় উপস্থিত ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়ন বিষয়ক বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আবদুল হাফিজ, সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড, এপিবিএন, আনসার, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “মব ভায়োলেন্স কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। জনগণ এখন অনেক সচেতন হয়েছে। জনগণই রুখে দাঁড়ালে এই প্রবণতা বন্ধ হবে। কারও আইন হাতে নেওয়ার অধিকার নেই।” তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, “মব ভায়োলেন্স, চাঁদাবাজি কোনোটিই মেনে নেওয়া হবে না। কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
মাদকবিরোধী লড়াইয়ের প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “মাদক সমাজে নানা উপায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। একে রুখতে সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে। মাদক কারবারীদের ধরতে হবে এবং শুধু বাহক নয়, মাদকের সঙ্গে জড়িত গডফাদারদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। মাদক ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংসের মাধ্যমে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনে। তাই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মানসিকতা পরিবর্তন করে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “গণমাধ্যমকেও এগিয়ে আসতে হবে জনসচেতনতা তৈরিতে। সমাজ থেকে মাদক নির্মূলে সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যমের বড় ভূমিকা রয়েছে।” রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গে তিনি জানান, “রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।”
সমন্বয় সভার পর বিকেলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্ত বিওপি পরিদর্শন করেন। সীমান্ত পরিস্থিতি, ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা এবং মাদক চোরাচালান রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি।
মোব ভায়োলেন্স এবং মাদক নির্মূলের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে চলমান প্রচেষ্টা এবং দেশের ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায় জুলাই অভ্যুত্থানকে স্মরণীয় করে রাখতে নেয়া উদ্যোগ নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এ সফর কক্সবাজারবাসীসহ দেশের মানুষের মাঝে নতুন প্রত্যাশার সঞ্চার করেছে।