অর্থাভাবে অনিশ্চিৎ ভবিষ্যৎ

শত প্রতিকূলতায় এসএসসিতে জেলায় সেরা আপন

এফএনএস (হাফিজুর রহমান হৃদয়; নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম) : | প্রকাশ: ১৮ জুলাই, ২০২৫, ০৭:২৩ পিএম
শত প্রতিকূলতায় এসএসসিতে জেলায় সেরা আপন

কিশোর বয়সেই সংসারের হাল ধরা হার না মানা এক লড়াকু সৈনিক নুরুন্নবী ইসলাম আপন। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া এই কিশোরের চোখেমুখে যখন আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন তখন আর কে ঠেকাবে তাকে। হাজারও প্রতিকূলতার মাঝেও জীবনের তরীটা অনুকূলে ফেরাতে অদম্য সাহস নিয়ে এগিয়ে যাবার প্রেরণা তাকে নিয়ে গেছে সাফল্যের শীর্ষে। এ বছর কারিগরি বোর্ডের অধীনে কুড়িগ্রাম জেলায় এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে আপন। ২ হাজার ৬০০ নম্বরের মধ্যে ২ হাজার ৩৩০ নম্বর পেয়ে জেলায় শীর্ষ স্থান দখল করেছে সে। চমকপ্রদ এই সাফল্য পেলেও চোখেমুখে তার হতাশার ছাঁপ। অর্থাভাবে কখনও কোচিংয়ের সুযোগ না পেয়েও  কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে নাগেশ্বরী সরকারি কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে এমন অর্জন তাক লাগিয়েছে জেলাজুড়ে। আপন ভূরুঙ্গামারী উপজেলার আন্ধারীঝার এলাকার হতদরিদ্র বাচ্চু মিয়া ও নুরজাহান বেগম দম্পতির ৩ ছেলে মেয়ের মধ্যে সবার ছোট। একজন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন লালন করলেও দারিদ্রতার কাছে এই স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নের বেড়াজালে আটকা তার। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও আপনের আগ্রহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে। টানা দুই বছর নাগেশ্বরী উপজেলা পর্যায়ে বিজ্ঞান মেলায় সেরা হয়ে ইউএনওর হাত থেকেও নিয়েছে পুরস্কার। 

স্থানীয়রা জানান আপনের বাবা বাচ্চু মিয়া ছ’মিলে কাজ করতে গিয়ে ৯ মাস আগে দূর্ঘটনায় পড়ে পা ভেঙে এখন চলাফেরায় অক্ষম। আর মা নুরজাহান বেগম বিগত দুই বছর ধরে শয্যাশায়ী। সোজা হয়ে বসতেও পারেন না। খাবার খাওয়ার সক্ষমতা না থাকায় তিন বেলাই তুলে খাওয়াতে হয় তাকে। তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় দুই বোনের কেউই অর্থাভাবে লেখাপড়া চালাতে পারায় একজন দশম শ্রেণি আরেকজনকে এসএসসি পাস করেই বিয়ে দিয়েছে পরিবার। পড়ে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই বাবা-মাসহ সংসারের যাবতীয় ভাড় পড়ে সবার ছোট আপনের উপর। শুরু হয় জীবন যুদ্ধ। টিনের চালা রান্নাঘরেই মোমবাতির আলোয় একদিকে রান্নাবান্না আর আহারের বন্দোবস্ত অন্যদিকে বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে গণিতের জটিল সূত্রের সাথে কষে জীবনের হিসাব। 

আপন জানায়, অষ্টম শ্রেণিতে থাকতেই টিউশনি কারানো শুরু করে সে। টিউশনের সামান্য আয়েই নিজের লেখাপড়ার খরচের পাশাপাশি চালাতে হয় বাবা-মায়ের ওষুধপত্র, চাল, ডালসহ সংসারের যাবতীয় খরচ। কিশোর বয়সে পড়াশোনার পাশাপাশি বন্ধুদের সাথে একটু আড্ডা কিংবা খেলাধুলা তো দূরের কথা দিনে তিনটি টিউশনি, দুপুরে ক্লাস, সন্ধ্যায় সংসারের কাজ আর রাতে স্কুলের পড়াশোনা। এভাবেই ঘড়ির কাটার মতো চক্রাকারে চলতো তার জীবনের গতি। তবুও তার স্বপ্ন একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে, মা-বাবা ও দেশের জন্য কিছু করার। কিন্তু ঢাকা কিংবা রংপুরে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা চালানোর মতো সামর্থ্য নেই তার। এ নিয়ে চাপা কষ্ট তার বুকে।

আপনের সহপাঠী রাকিবুল হাসান রোমান জানায়, স্কুলে সবাই জানত ও মেধাবী, কিন্তু ও যে কী ভয়াবহ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যায়, তা কাউকে বুঝতেও দিতো না। বরং ক্লাসের ফাঁকে নীরবে বই পড়ত। আপনের মা নুরজাহান বেগম জানায়, তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন এখন এই ছেলেটা। সে নিজে না খেয়ে আমাদের খাওয়ায়। এত কষ্ট করেও এমন রেজাল্ট করেছে, আল্লাহর অশেষ রহমত ছাড়া এটা হতো না। আন্ধারীঝাড় ইউপি সদস্য এরশাদুল হক বলেন, আপনের সাফল্য শুধু তার পরিবার না, গোটা গ্রামের গর্ব। সরকারের উচিত তার পাশে দাঁড়ানো।

নাগেশ্বরী টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাডেমিক ইনচার্জ শামীম আজম জানান, আপনের মতো প্রতিভাবান ছাত্রকে নিয়ে তারা গর্বিত। সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে কেউ তার উচ্চশিক্ষার দায়িত্ব নিলে তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্ব হতো।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে