থাইল্যান্ড–কাম্বোডিয়া সীমান্তে উত্তপ্ত সংঘর্ষের দ্বিতীয় দিন: প্রাণ হারিয়েছে ১৬ জন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | প্রকাশ: ২৫ জুলাই, ২০২৫, ০২:০১ পিএম
থাইল্যান্ড–কাম্বোডিয়া সীমান্তে উত্তপ্ত সংঘর্ষের দ্বিতীয় দিন: প্রাণ হারিয়েছে ১৬ জন

দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ আবারও রক্তক্ষয়ী রূপ নিলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড ও কাম্বোডিয়ার মধ্যে। এক দশকের মধ্যে সর্বাধিক সহিংস এই সংঘর্ষে শুক্রবার (২৫ জুলাই) টানা দ্বিতীয় দিনের মতো ভারী গোলাবর্ষণে অন্তত ১৬ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও অনেক। দুই দেশই একে অপরকে সংঘর্ষের জন্য দায়ী করছে, আর আন্তর্জাতিক মহল উদ্বেগ প্রকাশ করে শান্তি রক্ষার আহ্বান জানিয়েছে।

থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনীর দাবি অনুযায়ী, শুক্রবার ভোরের আগেই দেশটির উবন রাতচাথানি ও সুরিন প্রদেশজুড়ে কাম্বোডীয় সেনারা রুশ-নির্মিত বিএম-২১ রকেট লঞ্চার ও ভারী কামান ব্যবহার করে গোলাবর্ষণ শুরু করে। উত্তরে থাই সেনারাও পাল্টা হামলা চালায়। এই গোলাগুলি ছড়িয়ে পড়ে অন্তত ছয়টি স্থানে, যা সংঘর্ষের ব্যাপকতা ও তাৎক্ষণিকতা বোঝাতে যথেষ্ট।

তীব্র গোলাবর্ষণের মধ্যেই থাই কর্তৃপক্ষ জানায়, সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে প্রায় এক লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নারী, শিশু এবং প্রবীণরাও। থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, মৃত ১৬ জনের মধ্যে ১৪ জনই বেসামরিক মানুষ। আহত হয়েছেন অন্তত ৪৬ জন, যাদের মধ্যে ১৫ জন সেনাসদস্য।

অন্যদিকে, কাম্বোডিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার হতাহতের নির্দিষ্ট সংখ্যা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করলেও ওদার মিনচেই প্রদেশের প্রশাসনিক মুখপাত্র মেথ মিয়াস ফিয়াকডি নিশ্চিত করেছেন, সেখানে একজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত এবং পাঁচজন আহত হয়েছেন। এছাড়া প্রায় ১ হাজার ৫০০ পরিবারকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে নিরাপদ এলাকায়।

সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) সকালে, একটি বিতর্কিত সীমান্ত এলাকায় হালকা অস্ত্রের গোলাগুলির মাধ্যমে। তবে পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং উভয় পক্ষ ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষ শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগেই থাইল্যান্ড নমপেন থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে নেয় এবং কাম্বোডিয়ার দূতকে বহিষ্কার করে। একটি ভূমিমাইনের বিস্ফোরণে একজন থাই সেনার পা হারানোর ঘটনা এর পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে আসে। থাইল্যান্ড এই মাইন পুঁতে রাখার জন্য সরাসরি কাম্বোডিয়াকে দায়ী করলেও নমপেন এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে।

শুক্রবার থাই সেনারা ছয়টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান প্রস্তুত রাখে। এর মধ্যে অন্তত একটি বিমান থেকে কাম্বোডিয়ার একটি সামরিক স্থাপনায় বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এই পদক্ষেপকে “বেপরোয়া ও নির্মম সামরিক আগ্রাসন” হিসেবে আখ্যায়িত করেছে কাম্বোডিয়া। থাই পক্ষ দাবি করেছে, কাম্বোডীয় বাহিনী তাদের গ্রাম ও একটি হাসপাতালে রকেট হামলা চালানোর পর এ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে।

সংঘর্ষের তীব্রতা দেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও নড়েচড়ে বসেছে। যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষকে শান্তি স্থাপনের আহ্বান জানিয়ে বলেছে, “অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ, সাধারণ মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং সংলাপের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছানো প্রয়োজন।”

আঞ্চলিক সংস্থা আসিয়ানের বর্তমান সভাপতি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম এক্সে দেওয়া এক বিবৃতিতে জানান, তিনি থাইল্যান্ড ও কাম্বোডিয়ার নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের বিষয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত পেয়েছেন। তিনি লেখেন, “আসিয়ান পরিবারের অংশ হিসেবে মালয়েশিয়া এই প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।”

প্রেক্ষাপটে ফিরে তাকালে দেখা যায়, থাইল্যান্ড–কাম্বোডিয়ার মধ্যে ৮১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত বরাবর বহুদিন ধরেই বিরোধ রয়েছে। মূলত খামের-হিন্দু মন্দির তা মোয়ান থোম ও একাদশ শতকের প্রাচীন প্রেহ ভিহেয়ার মন্দিরকে কেন্দ্র করে এই বিরোধের সূত্রপাত। ১৯৬২ সালে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত (আইসিজে) প্রেহ ভিহেয়ার মন্দিরকে কাম্বোডিয়ার ভূখণ্ড বলে রায় দিলেও থাইল্যান্ড তা মানতে চায়নি। ২০০৮ সালে ইউনেস্কোর ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ তালিকায় মন্দিরটির অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া আরও উত্তেজনা সৃষ্টি করে।

চলতি বছরের জুনে কাম্বোডিয়া আবারও আইসিজের কাছে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য অনুরোধ জানায়। তবে থাইল্যান্ড জানিয়ে দেয়, তারা এই বিষয়ে কেবল দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চায় এবং আইসিজের হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়ার পক্ষে নয়।

বৃহস্পতিবার সকালে সংঘর্ষের শুরুর সময় পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে। থাই জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল জানায়, সকাল সাড়ে ৭টার পর সীমান্ত এলাকায় কাম্বোডিয়া একটি ড্রোন মোতায়েন করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরপিজি নিয়ে কাম্বোডীয় সেনারা জড়ো হয়। থাই সেনারা তাদের আলোচনা করতে ডাকলেও সাড়া না পেয়ে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। থাই ভাষ্যমতে, সকাল ৮টা ২০ মিনিটে কাম্বোডীয় বাহিনী গোলাবর্ষণ শুরু করে, যার উত্তরে থাই সেনারা জবাব দেয়। কাম্বোডিয়া এই দাবিকে অস্বীকার করে বলেছে, ভোর সাড়ে ৬টার দিকে থাই সেনারা খামের-হিন্দু মন্দির এলাকায় অনুপ্রবেশ করে এবং গুলি চালায়।

বিশ্লেষকদের মতে, থাইল্যান্ডের আধুনিক যুদ্ধবিমান ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে কাম্বোডিয়ার তুলনায় সামরিকভাবে নিজেদের প্রাধান্য জাহির করছে। তবে এই উত্তেজনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে সাধারণ মানুষ—যাদের প্রাণহানি, বাস্তুচ্যুতি এবং ভয়ের মধ্যে দিনযাপন এখন দুঃসহ।

পরিস্থিতি এখনও সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তবে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক মহলের কূটনৈতিক উদ্যোগ এবং উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনার আশাবাদী ইঙ্গিত একধরনের আশার আলো দেখাচ্ছে। সময়ই বলে দেবে—এই সংঘর্ষ আরও দীর্ঘায়িত হবে, নাকি তা সংযম ও সংলাপের মাধ্যমে মীমাংসায় পৌঁছাবে।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে